জাতীয়লিড নিউজ

জুলাই বিপ্লব এখন কাদের দখলে? হতাশ সর্বস্তরের মানুষ

যে বিপ্লব শুরু হয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দিয়ে, তা এখন সীমিত কিছু মুখের কৃতিত্বে বন্দি—বঞ্চিত অসংখ্য অংশীদার

এবিএনএ:

এক সময়ের অগ্নিগর্ভ আন্দোলন “জুলাই বিপ্লব” আজ যেন সীমিত হয়ে এসেছে গুটি কয়েক মুখের কৃতিত্বে। যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল কোটাব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে ছাত্রদের মাধ্যমে, তা দ্রুত রূপ নেয় এক সর্বাত্মক স্বৈরাচারবিরোধী জনজাগরণে। এই আন্দোলনে ছাত্র, শিক্ষক, নারী, আইনজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, সুশীল সমাজ—সকল স্তরের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।

তবে আজ, ১০ মাস পর দেখা যাচ্ছে, সেই বিপ্লবের সকল অংশীদার ক্রমেই উপেক্ষিত হয়ে পড়ছেন। আন্দোলনের মুখ্য কৃতিত্ব কিছু ছাত্রনেতা ও নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। এমনকি আন্দোলনে আঘাতপ্রাপ্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আজ মূল্যহীন।

বঞ্চনার চোরাবালিতে বিপ্লবের নায়করা

সরকারের ছায়ায় গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখন নিজেকে পুরো বিপ্লবের স্থপতি হিসেবে তুলে ধরছে। অথচ সত্য হলো—মাত্র ৩৬ দিনের আন্দোলনে ক্ষমতা বদল হয়নি; বরং তা এসেছে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ত্যাগ-তিতিক্ষার ফলস্বরূপ। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষপাতমূলক আচরণ প্রমাণ করছে—এটি সর্বজনীন নয়, বরং কেবল ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করছে।

প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য, “ছাত্ররাই আমার নিয়োগকর্তা”—সরকারের কাজেও তার প্রতিফলন ঘটছে। এতে জনগণের মধ্যে আস্থা কমে গেছে। অনেকেই মনে করছেন, বিপ্লব আজ নিজের লক্ষ্যচ্যুত।

নারী, সংস্কৃতি কর্মী ও আইনজীবীদের হতাশা

এই বিপ্লবের এক বড় চালিকাশক্তি ছিলেন নারীসমাজ। ঘরোয়া নারীরা পর্যন্ত রাজপথে এসে প্রতিবাদে অংশ নেন। কিন্তু এখন তারাই সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার। নারী নির্যাতন, হয়রানি, ধর্ষণ—সবই বেড়েছে।

সংস্কৃতি কর্মীরাও হতাশ। আজমেরী হক বাঁধন, জাকিয়া বারী মম, আজাদ আবুল কালাম, ইরেশ যাকেরসহ অনেকেই জুলাই আন্দোলনের সময় সোচ্চার ছিলেন। কিন্তু এখন তাঁদের অনেকেই হয় মিথ্যা মামলার শিকার, নয়তো অপমানের মুখোমুখি। অনুষ্ঠান বাতিল, সামাজিক হামলা, এমনকি গ্রেপ্তারও ঘটেছে। তাঁদের কণ্ঠ যেন রুদ্ধ।

আইনজীবীরাও বঞ্চিত। ব্যারিস্টার সারা হোসেন, জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, জেড আই খান পান্নার মতো মানুষেরা মুখ খুলেছেন, যাঁরা কখনও আদালতের মাধ্যমে ছাত্রদের মুক্তির জন্য লড়াই করেছিলেন। তাঁদের কারো কারো বিরুদ্ধে হত্যা মামলাও দায়ের হয়েছে!

শিক্ষক ও সুশীল সমাজও উপেক্ষিত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা যে সাহস দেখিয়েছিলেন, তা ভুলে যাওয়া হয়েছে। ড. আনু মুহাম্মদ থেকে শুরু করে শিক্ষক নেটওয়ার্ক এখন খোলাখুলি বলছেন—বাংলাদেশ আবারও এক নতুন স্বৈরতন্ত্রের দিকে হাঁটছে।

একজন শিক্ষককে উপাচার্য বানানো হলেও পরে তাঁকে সরানো হয়েছে। অন্যদিকে, এক বৃদ্ধা শিক্ষিকাকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। এসব ঘটনায় শিক্ষকদের মধ্যে গভীর অসন্তোষ তৈরি হয়েছে।

সুশীল সমাজের মানুষ, যেমন ড. শাহদীন মালিক, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এবং সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী, নূরুল কবীর সবাই স্পষ্টত হতাশা প্রকাশ করছেন। তাঁরা বলছেন, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন একটি গোষ্ঠীই এখন বিপ্লবের একচেটিয়া সুবিধাভোগী।

জুলাই বিপ্লব আজ কার কাছে বন্দি?

যাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সরকারবিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন—তাঁরা আজ নির্বাক। মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই। সমাজজুড়ে চলছে আতঙ্ক ও হতাশা। আন্দোলনে যাঁরা মূল চালিকাশক্তি ছিলেন, তাঁরা এখন বলছেন, “জুলাই বিপ্লব এখন মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর হাতে বন্দি।”

যেখানে স্বপ্ন ছিল বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্রব্যবস্থার, সেখানেই আজ দুর্বল গণতন্ত্র, বিভাজন ও স্বৈরতন্ত্রের ছায়া। জুলাই বিপ্লব কি সত্যিই সফল? নাকি, এটি একটি ব্যবহৃত ও বিস্মৃত অধ্যায় মাত্র?

Share this content:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button