এবিএনএ : অস্কার ও গ্র্যামিজয়ী ভারতের প্রখ্যাত গীতিকার, চলচ্চিত্র পরিচালক ও কবি গুলজার ঘুরে গেলেন বাংলাদেশ। এটা ছিল তাঁর প্রথম বাংলাদেশ সফর। ২৫ মার্চ তিনি রাজধানীর একটি অনুষ্ঠানে পড়ে শোনান তাঁর লেখা ও অনুবাদ করা কিছু কবিতা। ২৬ মার্চ সকালে নাশতার টেবিলে গুলজার বসেছিলেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সে সময় কথায় কথায় নিজের জীবনের অনেক গল্প শোনালেন তিনি।
অভিনেত্রী স্ত্রী রাখী গুলজারকে নিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না। তাতে যদি কষ্ট পান এই কিংবদন্তি! কম তো আর না, মেয়ে মেঘনার জন্মের বছর খানেক পর থেকেই গুলজার-রাখীর সংসারে দূরত্ব চলে আসে। এখন মেঘনা গুলজারের বয়স ৪২। সম্পর্ক ভাঙেনি গুলজার-রাখীর, তবে এখন আর তাঁরা এক ঘরের বাসিন্দা নন। তাই গুলজারের ব্যক্তিজীবনের সেই অধ্যায় নিয়ে কথা না বলার পরিকল্পনাই ছিল প্রথমে। কিন্তু অবাক করে দিয়ে সেই অধ্যায় থেকেই গল্প শুরু করলেন গুলজার।
রাখী ও পদ্মার ইলিশ
এখনো প্রতি ১৫ আগস্ট রাখীর বাড়িতে পৌঁছে যায় পদ্মার ইলিশ। গুলজারের পক্ষ থেকে এটা রাখীর জন্মদিনের উপহার। তখনো তাঁদের সংসারে বিবাদ বাসা বাঁধেনি, বাঙালি মেয়ে রাখী নাকি সে সময় গুলজারকে বলেছিলেন পদ্মার ইলিশের স্বাদ গঙ্গার ইলিশে মেলে না। সেই থেকে স্ত্রীর প্রিয় পদ্মার ইলিশ এখনো প্রতিবছর মুম্বাই পর্যন্ত নিয়ে যান গুলজার। বাংলাদেশে তাঁর পরিচিতজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঘাট থেকে বরফজমাট ইলিশ কেনা এখন যেন রীতিতে পরিণত হয়েছে।
ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে গুলজার,
স্ত্রী রাখীকে দিয়েই কিন্তু গুলজারের বাংলা আর বাঙালিপ্রীতির শুরু নয়। বাঙালিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গুলজারের জীবনকে এক অন্য আলোক দিশায় নিয়ে গেছে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় বর্তমান পাকিস্তানের ঝিলম জেলা থেকে পরিবারসহ গুলজার চলে আসেন ভারতে। তখন গুলজার নয়, তাঁর নাম ছিল সাম্পুরান সিং কালরা। পরিবারের সঙ্গে প্রথমে পাঞ্জাবের অমৃতসর, এরপর জীবিকার তাগিদে চলে যান বোম্বে। সেখানে কাজের ফাঁকে ফাঁকে বই পড়ার নেশা তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা, গান, গল্পের সঙ্গে। একে একে পড়তে শুরু করেন শরৎচন্দ্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়। এরপর যখন সিনেমার পোকা মাথায় ঢোকে, তখন বাঙালি বিমল রায়, ঋষিকেশ মুখার্জিদের মতো নির্মাতাদের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। এমনকি গীতিকার হিসেবে গুলজারের অভিষেক ঘটে বাঙালি সংগীত পরিচালক শচীন দেববর্মনের সঙ্গে কাজ করে। সময়ে সময়ে নিজের চারপাশে গুলজার খুঁজে পান সলিল চৌধুরী, দেবু সেন, বাসু ভট্টাচার্য, সুবোধ ঘোষ, রাহুল দেববর্মন, কিশোর কুমারের মতো বাঙালিদের বন্ধু আর শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে। এমনকি স্ত্রী রাখীর সঙ্গে গুলজারের পরিচয়টাও না-কি হয়েছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মাধ্যমে।
ঘোরাঘুরির ফাঁকে লিখছেন কবিতামেঘনা
ওহ্, আর রাখীর জন্ম তো এই বাংলাদেশেই। তিনিও ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর বাংলাদেশের ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে চলে গিয়েছিলেন। গুলজারের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার আগে সবাই তাঁকে চিনত রাখী মজুমদার নামে। তাঁর বাবা বাংলাদেশে পাটের ব্যবসা করতেন।
বাংলাদেশ থেকে রাখী আর পাকিস্তান থেকে গুলজার ভিটেমাটি হারিয়ে ভারতের ভূখণ্ডে গড়েন নিজেদের পৃথিবী। এসবের মধ্যে বাংলা, বাঙালি আর বাংলাদেশ একটা সময় এতটাই প্রভাবিত করে এই দম্পতিকে যে তাঁরা তাঁদের একমাত্র মেয়ের নাম রাখেন বাংলাদেশের নদীর নামে, মেঘনা।
সেই মেঘনা এখন অনেক বড়। বলিউডের গুণী পরিচালকদের একজন। তাঁর সবশেষ মুক্তি পাওয়া ছবি তালভার ২০১৫ সালে বলিউডের সবচেয়ে প্রশংসিত ছবির একটি। সেই মেঘনার কথাই প্রথমবার বাংলাদেশে এসে বারবার মনে করছিলেন গুলজার। তাঁকে যাঁরা বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের কাছে মেঘনা নদী দেখার আবদারও করেছিলেন। কিন্তু এক দিনের ছোট্ট সফরে মেঘনার কাছে যাওয়ার সময় হয়ে ওঠেনি।
একমাত্র মেয়ে মেঘনার সঙ্গেভাবনায় বঙ্গবন্ধু ও নজরুল
‘তাহলে ঢাকার কোথায় বেড়ানো হলো?’
এই প্রশ্নের জবাব গুলজার দিলেন না। তাঁকে যাঁরা আমন্ত্রণ জানিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছেন ‘লেইজার বাংলাদেশ’, সেই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শুক্লা সারওয়াত সিরাজ বললেন, ‘গুলজার সাহেবের কাছে দুটো পথ ছিল। একটি মেঘনা নদী দেখতে যাওয়ার। অন্যটি, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ও নজরুল ইনস্টিটিউট ঘুরে আসার। কারণ, এক দিনের মধ্যে তো মেঘনা নদী দেখে অন্য কোথাও যাওয়া সম্ভব ছিল না। পরে গুলজার সাহেব মেঘনা না দেখে, বঙ্গবন্ধু ও নজরুলের স্মৃতি ছুঁয়ে দেখতে যান।’
এরপরের কথাগুলো বললেন গুলজার। জানালেন, তাঁর পরের কাজ নজরুলকে নিয়ে। নজরুলের প্রেমের গান নিয়ে ভারতীয় সংগীতশিল্পী অজয় চক্রবর্তীর সঙ্গে কিছু কাজ করবেন তিনি। তৈরি করবেন একটি নজরুলসংগীতের অ্যালবাম। তাই ২৫ মার্চ শুক্রবার নজরুল ইনস্টিটিউট ঘুরে সেই অ্যালবামের জন্যই তথ্য আর নজরুল অভিজ্ঞতা নিয়ে গেলেন গুলজার।
এরপর গুলজার গিয়েছিলেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত সেই বাড়িতে। সেখানে গিয়ে লম্বা সময় কাটান গুলজার। সেই অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে তিনি এক দারুণ খবর জানান। বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি নাটক লিখতে চাই।’ তাঁর পাশে বসা সফরসঙ্গী ভারতীয় নাট্যনির্দেশক সেলিম আরিফের দিকে ইশারা করে বলেন, ‘ও যদি নাটকটি নির্দেশনা দিতে রাজি হয়, তাহলে হয়তো শিগগিরই এর কাজ শুরু করব।’
‘আসলে বাংলাদেশ সফরটা নিজেকে সমৃদ্ধ করার জন্য খুব জরুরি ছিল। এখানে এসে কিছু তথ্য সংগ্রহ না করলে, বঙ্গবন্ধু-নজরুলের স্মৃতিগুলো কাছ থেকে না দেখলে কাজগুলো আমি করতে পারতাম না।’ বলে গেলেন গুলজার।
পাশাপাশি গুলজার ও রাখীতবে মেঘনা নদী দেখার ইচ্ছা কিন্তু গুলজারের মনে দানা বেঁধে আছে এখনো। তাই ২৬ মার্চ বিমানবন্দরের উদ্দেশে বেরোনোর আগেও বলছিলেন, ‘এখানে প্রতিবছর যে সাহিত্য উৎসব হয়, সুযোগ হলে এবার সেখানে যোগ দেব। আর সে সময় মেঘনা নদীটাও দেখে নেব। কোন নদীর নামে মেয়েটার নাম রাখলাম দেখতে ইচ্ছা হয় খুব।’
গুলজারের লেখা কিছু জনপ্রিয় গান:
* জয় হো (স্লামডগ মিলিয়নিয়ার)
* তেরে বিনা জিন্দেগি সে কোই (আন্ধি)
* ছাইয়া ছাইয়া/অ্যায় আজনাবি (দিল সে)
* বিড়ি জালাইলে/ন্যায়না (ওমকারা)
* তেরে বিনা/মাইয়া মাইয়া (গুরু)
* সাজদে (কিল দিল)
* অ্যায় জিন্দেগি গালে লাগ যা (সাদমা)
* তুঝসে নারাজ নেহি জিন্দেগি/লাকড়ি কি কাঠি (মাসুম)
* মুসাফির হু ইয়ার (পরিচয়)
* সাথিয়া/চুপকে সে (সাথিয়া)
* সো যাও (হায়দার)
.পুরস্কার ও স্বীকৃতি
* ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছেন সাতবার।
* স্লামডগ মিলিয়নিয়ার ছবির ‘জয় হো’ গানের জন্য তিনি জিতেছেন অস্কার ও গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড
* গীতিকার হিসেবে সর্বোচ্চ ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার সম্মান পেয়েছেন গুলজার। মোট ১১ বার তিনি জিতেছেন সেরা গীতিকার হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার। অন্যান্য বিভাগে গুলজার আরও আটটি পুরস্কার পেয়েছেন, এর মধ্যে রয়েছে চিত্রনাট্যকার, পরিচালক ও আজীবন সম্মাননার পদক।
* ভারতীয় নাগরিকদের জন্য তৃতীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা পদ্মভূষণও অর্জন করেছেন তিনি।
* ভারতীয় চলচ্চিত্র অঙ্গনের সর্বোচ্চ সম্মাননা দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কারও জিতেছেন তিনি।
* ভারতের সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি।
বাংলা সাহিত্য থেকে অনুপ্রাণিত গুলজার পরিচালিত ছবি
* মেরে আপনে (১৯৭০)। বাঙালি নির্মাতা তপন সিনহা পরিচালিত ১৯৬৮ সালে মুক্তি পাওয়া বাংলা ছবি আপনজন-এর হিন্দি রিমেক ছিল মেরে আপনে।
* পরিচয় (১৯৭২)। রাজ কুমার মৈত্রের লেখা ‘রঙিন উত্তরীয়’ অবলম্বনে তৈরি হয়েছে ছবিটি।
* খুশবু (১৯৭৫)। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস পণ্ডিতমশাই অবলম্বনে ছবিটি নির্মাণ করেন গুলজার।
* কিতাব (১৯৭৭)। ছবিটি গুলজার তৈরি করেছেন সমরেশ বসুর গল্প ‘পথিক’ অবলম্বনে।
* নামকীন (১৯৮২)। সমরেশ বসুর ‘অকাল বসন্ত’ গল্প অবলম্বনে ছবিটি তৈরি করেছেন গুলজার।
* আঙ্গুর (১৯৮২)। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের কমেডি অব এররস্ অবলম্বনে ছবিটি তৈরি। তবে গুলজার আঙ্গুর নির্মাণের অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অনুবাদ করা ভ্রান্তিবিলাস থেকে।
* ইজাজাত (১৯৮৮)। সুবোধ ঘোষের ‘জতুগৃহ’ অবলম্বনে এ ছবিটি তৈরি করেছেন গুলজার।
(এ নিয়ে একটি মজার গল্পও শোনালেন তিনি। সুবোধ ঘোষকে যখন তিনি এই গল্পটির চিত্রনাট্য পড়ে শোনাচ্ছিলেন তখন নাকি সুবোধ ঘোষ বলেছিলেন, ‘এটা তো সেই গল্প নয়, তবে গল্পটা ভালোই লাগছে।’ ভয়ে ভয়ে গুলজার জানতে চান লেখকের কাছে, ‘দাদা, তাহলে কি আপনার নামটা এতে দেব?’ জবাবে সুবোধ ঘোষ বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, দিয়ে দাও। তুমি তো এর জন্য আমাকে পয়সা দিচ্ছই। নাম দিতে বাধা কিসের?’
* লেকিন (১৯৯১)। গুলজার তাঁর এই ছবিটি তৈরি করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্প অবলম্বনে।