
এবিএনএ : জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জনমনে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। যে কোনো নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি কঠোরভাবে প্রতিহত করতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশ এ ক্ষেত্রে হার্ডলাইন নেওয়ার পাশাপাশি ব্যাপক সতর্কাবস্থায় রয়েছে। এরই মধ্যে দেশব্যাপী শুরু হয়েছে ধরপাকড়।
এদিকে আগামীকাল বৃহস্পতিবার বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মামলার রায় ঘোষণার দিন ঢাকা মহানগর এলাকায় মিছিল এবং ছুরি-লাঠির মতো অস্ত্র বহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ওই দিন ভোর ৪টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকবে।
গতকাল পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী ডিআইজি থেকে তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলেছেন। সেখানে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুলিশের করণীয় নিয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। এ ছাড়া গতকাল বিকেলে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার সভাপতিত্বে শীর্ষ কর্মকর্তারা তাদের করণীয় নিয়ে আড়াই ঘণ্টা বৈঠক করেছেন। তেজগাঁওয়ে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার রায়-পরবর্তী বাংলাদেশ ভালো থাকবে। ৮ ফেব্রুয়ারি দেশে কোনো নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হতে দেব না। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের যা যা করার তাই করবে।
গতকাল ধানমণ্ডিতে একটি অনুষ্ঠানের পর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রায় ঘিরে বিএনপির কোনো ধরনের উস্কানিতে পা না দিতে দলের নেতাকর্মীদের সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সতর্ক ও সজাগ থাকবে। জনগণের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রয়োজনে আওয়ামী লীগ পুলিশকে সহায়তা করবে।
গতকাল সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে নয়াপল্টনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেফতার আর নির্যাতন করে দেশকে আদর্শ পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করেছে সরকার। একই সঙ্গে গণতন্ত্রকে কঙ্কালে পরিণত করেছে তারা। সরকার রাষ্ট্রীয় শক্তিকে আয়ত্তে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা-সমাবেশ-ঘরোয়া বৈঠক-চলাচল এমনকি ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে থামিয়ে দিচ্ছে।
গত ৩০ জানুয়ারি হাইকোর্ট এলাকায় প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে দুই কর্মীকে ছিনিয়ে নেয় বিএনপি নেতাকর্মীরা। এর পর থেকে দেশজুড়ে শুরু হয় গ্রেফতার অভিযান। বিএনপি দাবি করে আসছে, এখন পর্যন্ত তাদের ১১ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে সব জেলার পুলিশ সুপারকে সতর্ক করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দিয়েছে পুলিশ। গতকাল মঙ্গলবারও পুলিশের বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তারা বৈঠক করেছেন।
রায়ের দিন ঢাকায় মিছিলে নিষেধাজ্ঞা :ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ৮ ফেব্রুয়ারি বিচারাধীন একটি মামলার রায়কে কেন্দ্র করে জননিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা বিঘ্ন হতে পারে- এমন তথ্য গোয়েন্দা ও গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পেরেছে ডিএমপি। তাই ডিএমপি এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্সের ২৮ ও ২৯ ধারার অর্পিত ক্ষমতাবলে ৮ ফেব্রুয়ারি ভোর ৪টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সবরকম ছড়ি বা লাঠি, ছুরি, চাকু বা ধারালো অস্ত্র, বিস্ম্ফোরক দ্রব্য ও দাহ্য পদার্থ বহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ সময় যানবাহন ও জনসাধারণের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি এবং রাস্তায় দাঁড়িয়ে বা বসে কোনো ধরনের মিছিল করা যাবে না। শান্তি-শৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তা বজায় রাখতে সবার সহযোগিতা কামনা করেছেন কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া।
এর আগেও বিভিন্ন সময় পরিস্থিতি বিবেচনায় ঢাকা মহানগর এলাকায় মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে পুলিশ। ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনড় অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছিল পুলিশ। এ ছাড়া ২০১৩ সালের অক্টোবরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিলে একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। ২০১২ সালেও ঢাকায় মিছিল-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় পুলিশ। পরে এসব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছিল।
দফায় দফায় বৈঠক :চলমান পরিস্থিতিতে পুলিশের নীতিনির্ধারকরা গতকালও দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। গতকাল বিকেলে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনারসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে বৈঠক হয়। সেখানে বলা হয়, কোনোভাবেই জনগণের জানমালের ক্ষতি করতে দেওয়া হবে না। কেউ অরাজকতা সৃষ্টি করলে কঠোরভাবে দমন করতে হবে। বৈঠকে ঢাকাগামী বাস ও লঞ্চ যেখান থেকে ছেড়ে আসবে সেখানে নজরদারি করতে বলা হয়েছে। বাসে বা লঞ্চে কারা ঢাকায় আসছে, তা তদারকি করতে বলা হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত প্রভাবাধীন প্রতিষ্ঠানে নজরদারি বাড়ানোর কথাও বলা হয়েছে।
রাজধানীতে চেকপোস্ট :সোমবার সকাল থেকে রাজধানীর ১৩টি প্রবেশমুখে চেকপোস্ট বসিয়ে সন্দেহজনক যানবাহন তল্লাশি শুরু করেছে পুলিশ। এই চেকপোস্ট পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কাজ করবে। এ ছাড়া বিভিন্ন পয়েন্টে র্যাব বিশেষ টহল শুরু করেছে। প্রবেশমুখের পাশাপাশি রাজধানীর ভেতরে অর্ধশতাধিক পয়েন্টেও চেকপোস্ট বসিয়ে সন্দেহজনক ব্যক্তি ও যানবাহনে তল্লাশি করছে পুলিশ। এর মধ্যে রমনা ও শাহবাগে দুটি ও মিরপুরে চারটি বড় চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন থানা এলাকায় চেকপোস্ট বসিয়ে সন্দেহভাজনদের তল্লাশি অব্যাহত আছে।
ঢাকা ও এর আশপাশের জেলার পুলিশ সুপারকে তাদের নিজ নিজ জেলার আবাসিক হোটেল ও কোচিং সেন্টারগুলোতে কারা অবস্থান করছে, সেসব বিষয়ে খোঁজ রাখতে বলা হয়েছে। কোথাও চারজনের বেশি জড়ো হলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। রাজধানীসহ সারাদেশে নিরাপত্তা জোরদার করেছে র্যাবও। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, পুলিশ জননিরাপত্তায় সতর্ক থাকার পাশাপাশি আইনের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ কঠোরভাবে দায়িত্ব পালন করবে। এ পরিস্থিতিতে ঢাকা মহানগরীতে পুলিশ সদস্যদের ছুটি সীমিত করা হয়েছে।
জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা :খালেদা জিয়ার রায়কে ঘিরে আবারও রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। পরিবহন নেতারা নাশকতার আশঙ্কা করে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে অনুরোধ করেছেন।
মিরপুরে মুদি দোকানি আবদুর রহমান বলেন, আর জ্বালাও-পোড়াও চাই না। এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হলে ব্যবসায় ভাটা পড়ে। যাত্রাবাড়ীর এক গাড়ি ব্যবসায়ী বলেন, কোনো অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হলেই পরিবহন সংশ্নিষ্টরা সহজ টার্গেটে পরিণত হয়। এমন পরিস্থিতির শিকার হতে চান না তারা।
প্রেক্ষাপট :বহুল আলোচিত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় আগামীকাল বৃহস্পতিবার ঘোষণার জন্য দিন ধার্য রয়েছে। প্রসিকিউশন ও আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ঢাকার পঞ্চম বিশেষ আদালতের বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান গত ২৫ জানুয়ারি মামলার প্রধান আসামি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে এ দিন ধার্য করেন।
Share this content: