এবিএনএ স্পেশাল

মাধবদী কেন ভূমিকম্পের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলো? আতঙ্কের কারণ জানালেন বিশেষজ্ঞরা

মাধবদী কেন ভূমিকম্পের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলো? আতঙ্কের কারণ জানালেন বিশেষজ্ঞরা Sub-Title: ৮০০ বছরের সঞ্চিত শক্তি, ইন্ডিয়ান-বার্মা প্লেটের সংঘর্ষ ও ডাউকি ফল্ট—সব মিলিয়ে বাংলাদেশ বড় ভূকম্পনের দ্বারপ্রান্তে

এবিএনএ:বাংলাদেশের রাজধানীর খুব কাছেই অবস্থিত নরসিংদীর মাধবদী উপজেলায় শুক্রবার যে শক্তিশালী ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছিল, তার প্রভাব কেঁপে তুলেছিল ঢাকা ছাড়াও দেশের প্রায় সব জেলা। রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার এই ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত প্রাণ গেছে অন্তত ১০ জনের, আহত হয়েছে পাঁচ শতাধিক মানুষ। দেশের ভেতরে উৎপন্ন হওয়া সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম ভয়ংকর ভূকম্পন এটি বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক সংস্থা ইউএসজিএস জানায়, এই ভূমিকম্পে বাংলাদেশের প্রায় ৭ কোটি মানুষ ছোট-বড় ঝাঁকুনি অনুভব করেন। মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরের মাধবদী উপজেলার প্রায় ১০ কিলোমিটার ভূপৃষ্ঠের নিচে জমা হওয়া শক্তি হঠাৎ মুক্ত হয়ে বড় ধরনের কম্পনের সৃষ্টি করে।

এর মাত্র একদিন পর আবারও মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে নরসিংদীর পলাশ উপজেলায়। রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৩। ধারাবাহিক এসব কম্পন বিশেষজ্ঞদের মতে, বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

কেন মাধবদী ভূমিকম্পের কেন্দ্রবিন্দুতে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন, ভূমিকম্পটির উৎপত্তি হয়েছে ইন্ডিয়ান প্লেট ও বার্মা প্লেটের সংঘর্ষস্থলে। এই এলাকায় প্লেটগুলো একে অপরের নিচে প্রবেশ করছে বা সরে যাচ্ছে, ফলে ভূপৃষ্ঠের নিচে শত শত বছর ধরে শক্তি জমা হচ্ছে।

তার ভাষায়, “মাধবদীর নিচে প্লেট লকড অবস্থায় ছিল। শুক্রবার সামান্য অংশ খুলে গিয়ে শক্তি বেরিয়ে এসেছে। এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে সামনে আরও বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা রয়েছে।”

৮০০ বছরের সঞ্চিত শক্তি এখন ‘ফেটে পড়তে’ প্রস্তুত

তিনি জানান, বাংলাদেশে যে প্লেট সংযোগস্থল রয়েছে সেখানে ৮০০ বছরের বেশি সময় ধরে শক্তি জমা হচ্ছে। এই শক্তি ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটানোর মতো। আর মাধবদীতে সাম্প্রতিক ভূকম্পন ভবিষ্যতের বড় বিপর্যয়ের এক সতর্কবার্তা বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশের ভূকম্পনের প্রধান উৎস কী কী?

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে ভূমিকম্পের প্রধান দুটি উৎস হলো—

১️. ডাউকি ফল্ট, যা ভারতের শিলং মালভূমি থেকে ময়মনসিংহ-জামালগঞ্জ হয়ে সিলেট পর্যন্ত বিস্তৃত। দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার।
২️. সিলেট থেকে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে টেকনাফ এবং সেখান থেকে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা পর্যন্ত বিস্তৃত আরেকটি ভয়ংকর ফল্ট জোন।

এই অঞ্চলগুলোকে পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ টেকটনিক অঞ্চলগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

ইতিহাস বলছে ভয়ংকর সব ভূমিকম্পের কথা
🔹 ১৭৬২ সালে টেকনাফ-মিয়ানমার অঞ্চলে ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্পে সেন্টমার্টিন দ্বীপ তিন মিটার ওপরে উঠে আসে।
🔹 ১৭৯৭ সালে ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্র নদীর গতিপথ পাল্টে যায়।
🔹 ১৮৯৭ সালে জৈন্তাপুর-সুনামগঞ্জ অঞ্চলে রিখটার স্কেলে ৮.৭ মাত্রার ভূকম্পন হয়েছিল।
🔹 ১৯২২ সালে মৌলভীবাজার ও কিশোরগঞ্জ এলাকায় ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

ঢাকার বিপর্যয়ের আশঙ্কা বেশি কেন?
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল যেখানেই হোক, অপরিকল্পিত নগরায়ন, বহুতল ভবন এবং জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে রাজধানী ঢাকা।

বিশেষজ্ঞদের আহ্বান, “আর দেরি নয়, এখনই নিতে হবে কার্যকর প্রস্তুতি—নইলে বড় ভূমিকম্পে ভয়াবহ বিপর্যয় আসন্ন।”

ভূমিকম্প সচেতনতা, নগর পরিকল্পনা ও জরুরি প্রতিরোধ ব্যবস্থা এখন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button