জাতীয়বাংলাদেশলিড নিউজ

সৃষ্টিকর্তা ও জনগণ পাশে, ষড়যন্ত্র পরোয়া করি না: প্রধানমন্ত্রী

এবিএনএ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, সৃষ্টিকর্তা এবং জনগণ তার পাশে থাকলে তিনি এই লক্ষ্য অর্জনে কোনো কিছুকেই পরোয়া করেন না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমি এসব ষড়যন্ত্র দেখে আসছি। আমি এগুলোর পরোয়া করি না। আমি বিশ্বাস করি যতদিন মহান আল্লাহ এবং বাংলার জনগণ পাশে রয়েছেন, মা-বাবার দোয়া ও আশির্বাদ রয়েছে ততদিন এই লক্ষ্য অর্জনকে কেউ ঠেকাতে পারবে না।
বুধবার সকালে গণভবনে ৩৬তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কথা বলেন। খবর বাসসের
উল্লেখ্য, ১৯৮১ সালের এই দিনে পঁচাত্তরের ১৫ আাগস্টের বিয়োগান্তক অধ্যায়ের পর প্রবাস জীবনে থাকতে বাধ্য হওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে দেশে ফিরে আসেন। এর আগে তিনি ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা শেখ হাসিনার স্বামী দেশের বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার কর্মস্থল জার্মানী যান। ১৫ আগস্ট তারা দুজন বেঁচে গেলেও জাতির পিতার পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে সেদিন হত্যা করা হয়।
আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা দিবসটি উপলক্ষে এদিন প্রধানমন্ত্রীকে ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৩০ জুলাই আমি ও শেখ রেহানা দেশ ছেড়ে যাই। সেসময় বিদেশে যাওয়াতো ছিল স্বপ্নের মত ব্যাপার। কিন্তু সেবার বিদেশে যেতে যেন কিছুতেই মন টানছিল না। আমরা খুব কাঁদছিলাম। কিন্তু যেতে হলো। এই তেজগাঁও এয়ারপোর্ট হয়েই আমরা দিল্লী এবং সেখান থেকে জার্মানী। কামাল, জামাল, রাসেল সবাইকে রেখে গিয়েছিলাম। কামাল-জামালের বউ সুলতানা রোজী সবাই এসেছিল এয়ারপোর্টে। আর এই ১৭ মে যেদিন ফিরে আসি, সেদিন লাখো মানুষ। হাজার-হাজার মানুষ সেই মানুষদের ভীড়ে আমি ৩০ জুলাই যাদের রেখে গিয়েছিলাম। তাদের কাউকে পাইনি। আর বনানীতে গিয়ে পেলাম সাঁড়ি সাঁড়ি কবর। জানি না, আল্লাহ আমাকে কত শক্তি দিয়েছেন সহ্য করতে। এই দেশের জন্যইতো আমার আব্বা সারাটা জীবন এতো কষ্ট করেছেন। কারাগারে যেখানে তিনি (বঙ্গবন্ধু) ছিলেন সেটাতো আজ উন্মুক্ত। সবাই গিয়ে দেখে আসতে পারেন। তিনি (বঙ্গবন্ধু) দুঃখকে কোনদিন দুঃখ, কষ্টকে কোনদিন কষ্ট মনে করেননি। বাংলাদেশের মানুষের কথাই ভেবেছেন, আমার আব্বা এবং আম্মা দু’জনেই।
প্রধানমন্ত্রী স্মৃতি রোমন্থনে বলেন, একটাই লক্ষ্য নিয়ে সেদিন ফিরে এসেছিলোম এদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাব। সেটাই যেন করতে পারি। আর কোনো চাওয়া-পাওয়ার নেই।
আওয়ামী লীগ সভাপতি এ সময় আবেগাপ্লুত কন্ঠে বলেন, আমি দুঃখিত এত কথা যে আমাকে বলতে হবে সেটা চিন্তাও করি নাই। তবুও মনে হয় আমাদের আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদেরও জানার দরকার রয়েছে। আমি যখন দেশে ফিরি সে সময় আজকের অনেকের জন্মই হয়নি। আর তখন যারা ছিলেন তাদের অনেকেও বেঁচেও নেই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি একটাই কথাই বলব আমরা যারা রাজনীতি করি তারা যদি জাতির পিতার রাজনীতির দিকে তাকাই এবং তার আদর্শটা ধারণ করে রাজনীতি করি তাহলে আমরা দেশকেও কিছু দিতে পারব, দেশের মানুষকেও দিতে পারবো। মানুষ ধন-সম্পদের জন্য কতকিছু করে, কিন্তু মৃত্যু হলেতো আর কিছুই সাথে নিয়ে যেতে পারে না। সান-শওকত, বিলাসিতায় জীবন কাটালে মৃত্যুর পর অনেক কিছুই মিথ্যা হয়ে যায়। কাজেই মানুষের জন্য যদি কিছু করে যাওয়া যায়, সেটাই সব থেকে বড়ো পাওয়া। আমরা আব্বার কাছ থেকে মায়ের কাছ থেকে সেটাই শিখেছি। আর আজকে যতটুকু যাই চেষ্টা করে যাচ্ছি সেই শিক্ষা থেকেই করে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, এদেশকে এমন একটা জায়গায় পৌঁছানো আমার লক্ষ্য যেন আমার বাবার আত্মাটা শান্তি পায়।
তিনি আরো বলেন, ৭৫ এর ১৫ আগস্ট সব হারিয়েছি, সব হারিয়ে নিঃস্ব রিক্ত অবস্থায় বিদেশে ছিলাম।
পঁচাত্তরের বিয়োগান্তক অধ্যায় সম্পর্কে তিনি বলেন, কখনো ভাবতেও পারিনি এরকম ঘটনা আমাদের জীবনে আসবে। মাত্র ১৫ দিন আগে আমি আর রেহানা দেশে ছেড়ে বিদেশে যাই। অল্প সময়ের জন্য গিয়েছিলাম। চলে আসবো কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য ফিরতে পারলাম না। ’৭৫ এর কালো দিন আমাদের জীবনে সব কিছু কেড়ে নিয়েছিলো।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু আমরা হারিয়েছি তা তো না বাংলাদেশের জনগণ যে স্বপ্ন নিয়ে, যে আকাঙ্খা নিয়ে জাতির পিতার ডাকে অস্ত্র হাতে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। ক্ষুধা, দারিদ্র মুক্ত সমাজ গঠন, মর্যাদাসম্পন্ন স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো।
বিদেশে ১৫ আগস্টের সংবাদ শোনার প্রেক্ষাপট স্মরণ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, এ ঘটনাটা যখন আমরা শুনলাম তখন একদিকে যেমন স্বজন হারাবার বেদনা, অপর দিকে একথা বারবার মনে হচ্ছিল যে এ দেশটার জন্য সারা জীবন আমার বাবা কষ্ট করেছেন। আমরা সন্তান হিসেবে একটানা দুই বছর বাবাকে কাছে পাই নি। যে বয়সে ছেলে মেয়ে স্কুলে যায় বাবার হাত ধরে, আমাদের সে সৌভাগ্য কখনো হয়নি। যখন থেকে জ্ঞান হয়েছে বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছে কারাগারে। স্কুল-কলেজ জীবনে সব সময় ঐ কারাগারে যেয়েই সাক্ষাত করতে হতো। আমার বাবা একটা জাতির জন্য, একটা দেশের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তিনি নিজের জীবনের দিকে একবারও ফিরে তাকাননি। সব কিছু বিলীন করে দিয়েছিলেন এদেশের মানুষের জন্য। মানুষের স্বার্থে।
শেখ হাসিনা বলেন, তখন এদেশের ৮০/৯০ ভাগ মানুষই তো দারিদ্র্যের নিচে ছিলো। তারা একবেলা খাবার পেতো না, পরণে জীর্ণ কাপড়, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। যা আমার বাবাকে সব সময় পীড়া দিতো। মানুষের ভাগ্য গড়ার জন্যই তো তিনি সব কিছু ত্যাগ করেছিলেন। এমনকি আওয়ামী লীগের অগণিত নেতাকর্মী তারাও কম অত্যাচারিত-নির্যাতিত হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেকে তাকে (বঙ্গবন্ধুকে) সাবধান করেছিলেন, যে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু তিনি কখনো বিশ্বাস করতেন না। বলতেন যে ওরা তো আমার ছেলের মতো আমাকে কে মারবে। যিনি বাংলাদেশের জনগণকে এতটা ভালোবাসা দিয়েছিলেন তাদের একটা বিক্ষিপ্ত অংশের গুলিতে জীবন দিতে হলো বঙ্গবন্ধুকে। আমার এখনো মনে হয়, তাকে গুলি করছে তারই দেশের লোক, তার হাতে গড়া ঐ সেনাবাহিনীর সদস্য। তার হাতে গড়া মানুষ। জানি না তার মনে তখন কি প্রশ্ন জেগেছিলো? কিছু জানারও উপায় নেই, কারণ ঐ বাড়িতে তো কেউ বেঁচে ছিলো না।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় তার পরিবারের নিহত সকল সদস্যেও বিবরণ তুলে ধরেন।
১৫ আগস্টের পর অপপ্রচার চালানো হয়েছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একাত্তরে পরাজিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর যারা দোসর ছিলো, তাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিলো। যারা এদেশের স্বাধীনতাই চায়নি। মূলত তারাই এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আসলে ঘরের শত্রু বিভীষণ। ঘরের ভেতর থেকে শত্রুতা না করলে বাইরের শত্রু সুযোগ পায় না। যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের অনেকে আমাদের বাসায় আসা যাওয়া করতো।
তিনি বলেন, ডালিম, ডালিমের শাশুড়ি, ডালিমের বউ, ডালিমের শালী, ২৪ ঘণ্টা আমাদের বাসাই পড়ে থাকতো। ওঠা বসা, খাওয়া, দাওয়া সবই করতো।
বঙ্গবন্ধুর হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, মেজর নূর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে কর্মরত ছিলো। তখন কামালও ওসমানীর এডিসি ছিলো। দুই জন এক সঙ্গে কর্মরত ছিলো। এরাতো অত্যন্ত চেনা মুখ।
তিনি বলেন, কর্নেল ফারুক কেবিনেটের অর্থমন্ত্রী মল্লিক সাহেবের শালীর ছেলে। এভাবে যদি দেখি এরা কেউ দূরের না, এরাই যড়যন্ত্র করলো।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জিয়া জড়িত ছিলো। জিয়ার যে পারিবারিক সমস্যা ছিলো সেটা সমাধানের জন্য সেনাবাহিনীতে এক পদ সৃষ্টি করে সেখানে তাকে দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছিলো। তার পারিবারিক সমস্যা সমাধান করে দেয়া হয়েছিলো।
তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান প্রায়ই, প্রতি সপ্তাহে এক বার তার স্ত্রীকে নিয়ে ঐ ৩২ নম্বর বাড়িতে যেতো। ‘আন্তরিকতা’ নয়, এদের লক্ষ্য ছিল চক্রান্ত করা। সত্যিকথা বলতে কি সেটা কেউ বুঝতে পারিনি। আমরা খোলামেলা মানুষের সঙ্গে মিশতাম, সকলের জন্য ছিল অবারিত দ্বার।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ হত্যাকাণ্ড হয়েছে ইতিহাসকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করা, মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা, স্বাধীনতার যে মূল লক্ষ্য সেটা থেকে বিচ্যুত করা এবং বিজয়কে একেবারে অর্থহীন করে দেয়ার জন্য।
মোস্তাক তিন মাসও ক্ষমতায় থাকতে পারেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা এভাবে বেঈমানী করে, তারা থাকতে পারে না।.. মীর জাফরও তিন মাসও ক্ষমতায় থাকতে পারেনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মোস্তাক রাষ্ট্রপতি হওয়ার সাথে জিয়াউর রহমানকে সেনা প্রধান করা হয়। এতে স্পষ্ট যে তাদের মধ্যে একটা যোগসূত্র ছিলো এবং ষড়যন্ত্র জড়িত ছিলো।
জার্মানীর বনে বসে ১৫ আগস্টে পরিবারের সব সদস্য নিহত হবার সংবাদ প্রাপ্তির দুর্বিসহ সময়টার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখন শুনলাম সহ্য করাটা কঠিন ছিলো। ১৬ তারিখে ড. কামাল হোসেন আসলেন বনে হুমায়ন রশিদ সাহেবের বাসায়। রেহানা ছোট, সে বললো চাচা আপনি মোস্তাকের মন্ত্রীত্ব নেবেন না। আপনি প্রেস কনফারেন্স করেন, আপনি এ হত্যার প্রতিবাদ করেন। হুমায়ন রশিদ সাহেব প্রেস কনফারেন্সের ব্যবস্থা নিলেন কিন্তু উনি কোন কথা বলতে রাজি হলেন না।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় দেশবাসীর প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, গ্রামে গঞ্জে যখন ঘুরেছি তখন দেখেছি সাধারণ মানুষের ভালবাসা। সে ভালবাসাই কিন্তু আমাদের আরো প্রেরণা দিয়েছে।

Share this content:

Related Articles

Back to top button