সন্ত্রাসবাদী হামলার নয়া কায়দা!

এবিএনএ : স্পেনে আট ঘণ্টার ব্যবধানে দুটি শহরে চালানো সন্ত্রাসবাদী হামলা অন্তত ১৪ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়। দুটি হামলাই একই কায়দায় চালানো হয়। কায়দাটি হলো পথচারীদের ভিড়ে গাড়ি তুলে দেওয়া। ইউরোপে সাম্প্রতিক কিছু সন্ত্রাসবাদী হামলার কথা খেয়াল করলেই মনে হতে পারে, সন্ত্রাসবাদীরা কি হামলার নয়া কায়দা হিসেবে পথচারীদের ভিড়ে গাড়ি তুলে দেওয়ার কৌশল বেছে নিয়েছে?
ইউরোপে সন্ত্রাসবাদী হামলার ক্ষেত্রে এই কায়দার ব্যবহার আমরা দেখছি আড়াই বছরের কিছুটা বেশি সময় ধরে। এমন হামলার শিকার বেশি হয়েছে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য। দুটি দেশই তিনবার করে এভাবে রক্তাক্ত হয়েছে। যুক্তরাজ্যে তিনটি হামলাই হয়েছে লন্ডনে। সুইডেন ও জার্মানিতে একবার করে এই হামলা হয়েছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার এমন হামলার শিকার হলো স্পেন।
এখন পর্যন্ত মোট নয়টি হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১২৯ জন। হিসাবে হামলাকারীদেরও ধরলে প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। হামলাগুলোয় আহত হন অসংখ্য মানুষ। আর এই নয়টি হামলার মধ্যে ছয়টিই হয়েছে চলতি বছর। আরও নির্দিষ্ট করে চলতি বছরের ২২ মার্চ থেকে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যেই।
পথচারীদের ভিড়ে গাড়ি তুলে দিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা আমরা প্রথম দেখতে পাই ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে, ফ্রান্সে। নানতেস এলাকার একটি খ্রিষ্টান মার্কেটে এবং দিজন এলাকায় পথচারীদের ওপর গাড়ি তুলে দেওয়ার ওই ঘটনায় অবশ্য কারও প্রাণহানি হয়নি। আহত হয়েছিলেন ২০ জন। এরপর ফ্রান্স আরও দুবার এই কায়দার হামলার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ভয়াবহতম হামলার ঘটনা ঘটে গত বছরের ১৪ জুলাই নিস শহরে। বাস্তিল দিবসের উৎসব শেষে ঘরমুখী মানুষের ভিড়ে ট্রাক চালিয়ে দিয়ে হত্যা করা হয় ৮৬ জনকে। এরপর গত ৯ আগস্ট একটি সেনাদলের ওপর গাড়ি তুলে দেওয়া হয় প্যারিসে। এতে ছয়জন আহত হন।
লন্ডনে প্রথম হামলা হয় চলতি বছরের ২২ মার্চ। ওয়েস্টমিনস্টার সেতুতে পথচারীদের ওপর গাড়ি তুলে দিয়ে চারজনকে হত্যা করার পর চালক ছুরিকাঘাতে হত্যা করেন একজন পুলিশ সদস্যকে। এরপর ৩ জুন লন্ডন ব্রিজে একই কায়দায় আটজনকে হত্যা করা হয়। আর ১৯ জুন ফিন্সবারি পার্কে নামাজ পড়ে ঘরে ফিরতে থাকা মানুষের ওপর গাড়ি তুলে দিয়ে হত্যা করা হয় একজনকে।
চলতি বছর ৭ এপ্রিল সুইডেনে লরি চাপা দিয়ে চারজনকে এবং গত বছর জার্মানিতে ক্রিসমাস মার্কেটে ট্রাক তুলে দিয়ে ১২ জনকে হত্যা করা হয়।
বার্সেলোনায় গত বৃহস্পতিবারের হামলার দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট (আইএস)। এ ছাড়া ফ্রান্সে বাস্তিল দিবসের ভয়াবহতম হামলা, লন্ডনের প্রথম দুটি হামলা, জার্মানি ও সুইডেনে হামলার পেছনে আইএসের হাত আছে। এসব হামলার অধিকাংশেরই দায় সরাসরি স্বীকার করেছে এই সংগঠন। আর যেগুলোর দায় সরাসরি স্বীকার করেনি, সেগুলোর ক্ষেত্রে আইএস বলছে, তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়েই হামলাকারী এই হামলা চালিয়েছে। আইএসের এসব দাবিকে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। কারণ, তদন্তের পর সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর গোয়েন্দারাও বলছেন আইএসের কথা। যারা সরাসরি আইএসের কথা বলেনি, তারা হামলার জন্য ‘ইসলামি জিহাদি’ বা ‘ইসলামি সন্ত্রাসীদের’ দায়ী করেছে।
বিশেষ করে ইরাক ও সিরিয়ায় সক্রিয় আইএসের এত দিনের হামলাগুলোয় আমরা দেখেছি প্রথাগত অস্ত্র বা কৌশলের ব্যবহার। তারা ট্যাংক-বন্দুক, বোমা বা এ ধরনের অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করেছে। আইএস তার উত্থানপর্বে এলাকার পর এলাকা দখলের সময় পাল্টা হামলা থেকে বাঁচতে স্থানীয় বেসামরিক মানুষকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। মানুষকে জিম্মি করে পরে শিরশ্ছেদের দৃশ্য ভিডিও ধারণ করে ইন্টারনেটে প্রকাশ করেছে। এরপর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইএস সদস্যরা আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছে।
কিন্তু ইউরোপে তাদের সাম্প্রতিক হামলাগুলো হচ্ছে গাড়ি চাপা দিয়ে। আগের হামলাগুলোর ধরন পাল্টে গাড়িচাপাকে বোধ হয় নতুন কায়দা হিসেবে বেছে নিয়েছে আইএস বা তার অনুসারীরা। কিছুদিন ধরেই ইরাক ও সিরিয়ায় সরকারি বাহিনীর হামলায় বেশ বিপর্যস্ত আইএস। ইরাকে তো তাদের শক্ত ঘাঁটি মসুলের প্রায় পতন ঘটেছে। এই বিপর্যয়ে অস্ত্র-যুদ্ধ সরঞ্জাম ধ্বংস হয়েছে তো বটেই, নিহত হয়েছে অনেক আইএস সদস্য। এমন বিপর্যয় আসছে, সেটা সম্ভবত আঁচ করতে পেরেছিল আইএস। কারণ, মসুল পতনের বেশ আগে থেকেই বিভিন্ন এলাকা থেকে পিছু হটছিল আইএস যোদ্ধারা। বিপর্যয়ের আশঙ্কা মাথায় রেখেই হয়তো হামলার নতুন কায়দা গাড়ি চাপা দিয়ে হামলার কৌশল নেয় সংগঠনটি। কারণ, এই কায়দায় তো হামলার জন্য অস্ত্র সরবরাহ বা প্রশিক্ষণ দেওয়ারও ঝুঁকি নেই! একটি গাড়ি ভাড়া করে দ্রুতগতিতে ছুটিয়ে মানুষের ভিড়ে তুলে দিতে পারলেই হলো!
Share this content: