জাতীয়বাংলাদেশলিড নিউজ

সংসদে সমালোচনার মুখে স্বাস্থ্যমন্ত্রী

এবিএনএ : করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে জাতীয় সংসদে সমালোচনার মুখে পড়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। সমন্বয়হীনতার অভিযোগ তুলে তার অপসারণ দাবি করেছেন জাতীয় পার্টি (জাপা) ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা।মঙ্গলবার জাতীয় সংসদের ২০২০-২১ অর্থ বছরের বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মঞ্জুরি দাবি ও বিরোধী এমপিদের ছাঁটাই প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে তারা এ দাবি করেন। এ সময় জাপা ও বিএনপির এমপিরা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কঠোর সমালোচনা করেন। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, করোনা আক্রান্ত হয়ে ভেন্টিলেটরে যাওয়া রোগীদের প্রায় সকলেই মারা গেছেন। করোনা চিকিৎসায় ভেন্টিলেটরের কোন প্রয়োজন নেই। দেশের চার’শ ভেন্টিলেটরের মধ্যে সাড়ে তিনশ’ ব্যবহারই হয়নি। এ ছাড়াও ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসকদের থাকা খাওয়ায় কোন দুর্নীতি হয়নি বলেও মন্ত্রী এসময় দাবি করেন।

তিনি বলেন, করোনার চিকিৎসায় কেউ কিন্তু আগে বলেনি পিপিই লাগবে। যখন বলা হলো তখন সারাবিশ্ব লকডাউন। এ কারণেই পিপিই পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে ধীরে ধীরে ববস্থা করা হয়েছে। এখর আর এই অভিযোগ নেই। ইতোমধ্যে প্রায় ৩০ লাখ পিপিই সরবরাহ করা হয়েছে। এখন হাইফ্লো অক্সিজেনের প্রয়োজনের কথা বলা হচ্ছে। এক হাজার অক্সিজেনের অর্ডার দেওয়া হয়েছে। প্রায় ১০ হাজার নতুন সিলিন্ডার বানানো হয়েছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, সংসদ সদস্যরা শুধু দোষারোপ করলেও সরকারের কী কাজ করেছে তা বলেননি। চীনে কোভিড দেখা দেওয়ার পরপরই পোর্টগুলোতে স্ক্রিনিংসহ সবধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ফলে দেশে করোনায় মৃত্যুর হার ১ দশমিক ২৬ শতাংশ। এই হার ভারতে ৬ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ১৫ শতাংশ যুক্তরাজ্যে ১৪ শতাংশ। এটা এমনিতেই হয়নি। সকলে কাজ করেছে বলেই এটা হয়েছে।

চিকিৎসক আক্রান্ত হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে মন্ত্রী বলেন, পিপিই কীভাবে পড়তে হবে এবং খুলতে হবে এই বিষয়টি জানা না থাকার কারণেই তারা আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের প্রশিক্ষণের পর আক্রান্তের হার কমে গেছে।

মন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাসের ৮০ শতাংশ রোগীর কোন লক্ষণ দেখা দেয় না। ১৫ শতাংশের ছোট লক্ষণ দেখা দেয়। আর ৫ শতাংশের জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। ৮০ শতাংশ রোগীকে বাসায় রেখে টেলিমেডিসিন সেবার মাধ্যমে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেশের টেস্টিং ক্যাপাসিটি বাড়ছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, মাত্র একটি টেস্টিং ল্যাব থেকে দেড় মাসে ৬৮টি ল্যাব করা হয়েছে। দিনে মাত্র দেড়শটা টেস্টের ব্যবস্থা থেকে বাড়িয়ে ১৮ হাজারে উন্নীত করা হয়েছে। আরো টেস্ট দরকার। করলে ভালো হয়। কিন্তু কোটি কোটি লোককে টেস্ট করতে পারবেন না। এটা মানতে হবে। সরকারের উদ্যোগের ফলে বেসরকারি হাসপাতালগুলো করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত হয়েছে মন্তব্য করে জাহিদ মালেক বলেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলো করোনা চিকিৎসার উদ্যোগ নেয়নি। সরকার তাদের নিয়ে এসেছে। এখন তারা কোভিড চিকিৎসা দিচ্ছে। তবে, এটা ঠিক তারা বিলটা একটু বেশি করছে।

রোগী সেবা পাচ্ছে না এই অভিযোগ আর কোথাও নেই দাবি করে মন্ত্রী বলেন, মোট বেডের ৬০ শতাংশে এখন রোগী আছে। ৪০ শতাংশ বেড এখনো খালি পড়ে রয়েছে। প্রায় ১৪ হাজার বেড করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত আছে। সেখানে রোগী আছে চার হাজার। তিনি বলেন,  মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলে এই সংক্রমণের হারও কমবে বলে আশা করি। সংসদ সদস্যদের সমন্বয়হীনতার অভিযোগ অস্বীকার করে মন্ত্রী বলেন, তাদের মধ্যে কোনও সমন্বয়হীনতা নেই। ৫ মাস তারাই মাঠে ছিলেন। ২৫ দিনে বসুন্ধরায় দুই হাজার বেডের হাসপাতাল বানিয়েছেন। তিনি বলেন, সকলের সহযোগিতা পেলে কোভিড চলে যাবে। স্বাভাবিকভাবে অর্থনীতি এগিয়ে যাবে।

ঢাকা মেডিকেলের করোনা সম্পর্কিত চিকিৎসকদের থাকা-খাওয়ার বিষয়ে যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তা সঠিক নয় বলে দাবি করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজের থাকা-খওয়ার বিষয়ে তিনি খোঁজ নিয়েছেন।  ৫০টি হোটেল ভাড়া হয়েছে। সেখানে তিন হাজার ৭০০ মানুষ একমাস থেকেছে। প্রত্যোকটি রুমের ভাড়া ১১০০ টাকা। খাওয়ার খরচ যেটা বলা হয়েছে তা টোলালি রং। সেখানে দিনের তিনটি মিলের জন্য খরচ ৫০০ টাকা হয়েছে। এর আগে আলোচনায় অংশ নিয়ে সংসদের পধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, দেশে করোনায় আক্রান্ত ও নিহতের সংখ্যা তুলনামুলকভাবে কম। যতটা আশঙ্কা করা হয়েছিল তত আক্রান্ত হয়নি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা করে তিনি বলেন, সব কিছু যদি প্রধানমন্ত্রীরই করতে হয় তাহলে মন্ত্রণালয়-অধিদপ্তর এত রাখার তো দরকার নেই। এত টাকা খরচ করে লাভ কী? প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাই অনুসরণ করা হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মধ্যে কোন সমন্বয় নেই। দেখা যায় অধিদফতরের সিদ্ধান্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানেনও না। তিনি বেসরকারি হাসপাতালগুলো অধিগ্রহণ করে কোভিড ও ননকোভিড  দুটো সেকশনে আলাদা করে ফেলার প্রস্তাব দেন।

জাতীয় পার্টির আরেক এমপি শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দিয়ে দেশের ১৮ কোটি মানুষের সেবা দেওয়া অসম্ভব। চিকিৎসা সেবা সম্পর্কিত সেক্টরগুলোতে ননডাক্তারদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। মেডিকেল সেক্টরের প্রশাসন থেকে শুরু করে সব কিছু ডাক্তারদের হাতে রাখা দরকার। দেশে হেলথ ডাটাবেজ নেই। এটা জরুরি।

জিম্বাবুয়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে পিপিই ও কিট কেনার দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, করোনাকালে এসে আমাদের এই রুগ্ন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুরবস্থা। মানুষ বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নাকি মীনা কার্টুনে পরিণত হয়েছে। মীনা কার্টুনের টিয়া পাখি (মিঠু) দিয়ে চলছে এই মন্ত্রণালয়।

পীর ফজলুর রহমান বলেন, এলাকায় গেলে মানুষেরা আমাকে অনুরোধ করেন যে আমি যেন সংসদে গিয়ে বলি স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে অন্যকোন দায়িত্ব দিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়টাকে সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর কাছে হস্তান্তরর করতে। আমি প্রধানমন্ত্রীকে মানুষের এই কথাটা নিবেদন করলাম।

জাতীয় পার্টির এমপি রওশন আরা মান্নান বলেন, সারা বিশ্বের মানুষ স্বাস্থ্য খাত ও নিজেদের স্বাস্থ্য নিয়ে এখন ব্যস্ত। সেবাখাতের সাথে বেশি দুর্নীতি থাকে। এজন্য বলবো স্বাস্থ্যখাতে অবশ্যই দুর্নীতি রয়েছে। আমি এজন্য বলতে চাই স্বাস্থ্যমন্ত্রী যদি বিবৃতি দেন- এই খাতে কী ছিলো? এখন কী আছে? উনি কী করেছেন? কত ভেন্টিলেশন আছে? কেন কীট পাওয়া যায় না? কেন মানুষ মারা যাচ্ছে? করোনা নিয়ে সরকার কী করেছে এটা নিয়ে যদি বিবৃতি দিতেন।

জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক (চুন্নু) বলেন, শুরু থেকে ব্যবস্থা নেয়া হলে করোনা এতটা ছড়াতো না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি আগে বলেছিলেন আমাদের এখানে তাপমাত্রা বেশি করোনা ছড়াবে না। এখন তিনি বলছেন করোনা দুই/তিন বছরে যাবে না। জানি না সরকারি দপ্তরে বসে কীভাবে তারা কথা বলেন?

তিনি বলেন, নিম্নমানের পিপিই দেয়ার কারণে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হয়েছেন। নিম্নমানের স্বাস্থ্য সামগ্রী দেয়ার জন্য দেখলাম দু:খপ্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে যারা মারা গেছেন তাদের কী জবাব দেবেন। চুন্নু তার বক্তব্যে সকল এমপি-মন্ত্রী-সরকারি কর্মকর্তা সবাই সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করবে। দেশে চিকিৎসা করবে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বিদেশে যাবেন না- এমন নির্দেশনা দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ করেন।

বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, সুচিকিৎসার পূর্বশর্ত হলো সঠিক রোগ নির্ণয়। জেলা উপজেলার হাসপাতালে অবকাঠামো আছে কিন্তু টেকনোলজিস্ট সঙ্কটে পরীক্ষাগুলো হয় না। আমাদের সম্পূর্ণ চিকিৎসা ব্যবস্থা ভারতমুখী হয়ে গেছে। এই চিৎিসা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। জনবল সঙ্কট নিরসন করতে হবে।

তিনি বলেন, করোনায় সারাবিশ্বে মানুষ মারা যাচ্ছে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু করোনা রোগীকে কতটুকু চিকিৎসা নিশ্চিত করা গেছে সেটা দেখতে হবে।  তার মতে, বাংলাদেশে আক্রান্তের হার সব থেকে বেশি। প্রতিদিন যে পরীক্ষা হচ্ছে তার ২৩ শতাংশ পজিটিভ আসছে। আর ১০/১৫দিন পর পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে। যার কারণে সংক্রমণের হার বেড়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সমন্বয়হীনতা রয়েছে অভিযোগ করে তা সংস্কার করার প্রস্তাব করেন তিনি।

Share this content:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button