এবিএনএ: বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণের মধ্যদিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো প্রবেশ করেছেন হোয়াইট হাইজে। সেই অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন বিশ্বের বহু রথি-মহারথি।
এদিন শপথ নিয়েই গোটা বিশ্বে রীতিমতো ভীতির সঞ্চার করেছেন ‘ক্ষ্যাপাটে’ ট্রাম্প। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তিনি উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নির্বাহী আদেশে সই করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে যা নজিরবিহীন। সর্বমোট ২০০টি নির্বাহী আদেশের ঘোষণা তিনি দিতে পারেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর।
দায়িত্ব গ্রহণের পর বিভিন্ন ধরনের নির্বাহী আদেশ জারি করা মার্কিন প্রেসিডেন্টদের জন্য সাধারণ একটি বিষয়। এ ধরনের আদেশের আইনি ভার আছে। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট বা আদালত চাইলে এসব আদেশ বাতিল করতে পারেন। তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আগামী চার বছর।
আপাতত চলুন দেখে নেওয়া যাক, প্রেসিডেন্ট হিসেবে আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব গ্রহণের পর কী কী নির্বাহী আদেশে সই করেছেন এবং করতে পারেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
শুল্ক বৃদ্ধি
যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পোৎপাদন খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে আমদানি পণ্যের ওপর ব্যাপক শুল্কারোপের আশ্বাস দিয়েছেন ট্রাম্প। প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে চীনসহ বিভিন্ন দেশের আমদানি পণ্যের ওপর শুল্কারোপ করেছিলেন তিনি। জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর সেটি বজায় রেখেছিলেন।
তবে এবার ট্রাম্প সব ধরনের আমদানি পণ্যে ১০ শতাংশ শুল্কারোপের আশ্বাস দিয়েছেন। এর মধ্যে কানাডা ও মেক্সিকোর পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ এবং চীনের পণ্যের ওপর ৬০ শতাংশ শুল্কারোপ করা হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এসব শুল্ক ভোগ্যপণ্যকে আরও ব্যয়বহুল করতে পারে এবং মূল্যস্ফীতি বাড়াতে পারে। কিছু দেশ এর বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক শুল্কারোপের কথা ভাবছে।
দক্ষিণ সীমান্তে জরুরি অবস্থা জারি
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্তে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন ট্রাম্প। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ওভাল অফিসে ফিরে এই ঘোষণা দেন তিনি। এ সংক্রান্ত একটি নির্বাহী আদেশে সই করেছেন তিনি। বলেন, ‘এটি একটি বিশাল সিদ্ধান্ত।’
জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিল
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবৈধভাবে বা শিক্ষা-পর্যটনসহ সাময়িক ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে এসে সন্তান জন্ম দিলে শিশু মার্কিন নাগরিকত্ব পাবে না। তবে বাবা-মায়ের কেউ আমেরিকান নাগরিক হলে সন্তান জন্মের পরই মার্কিন নাগরিক বলে স্বীকৃতি পাবে।
এই নির্বাহী আদেশে সই করার সময় ট্রাম্প স্বীকার করেন যে, জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকার যেহেতু দেশের সংবিধানে নিশ্চিত করা আছে, তার এই আদেশ আইনগত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।
তিনি জানান, জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব একেবারে হাস্যকর এবং তার বিশ্বাস, এই বিধান বদলানোর জন্য ভালো আইনগত যুক্তি আছে।’
সীমান্ত বন্ধ
১৯৪৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেওয়া পদক্ষেপ ‘টাইটেল ৪২’-এর অধীন জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিতে অভিবাসন কমাতে পারে মার্কিন সরকার। সবশেষ করোনা মহামারির সময় টাইটেল ৪২ ব্যবহার করা হয়েছিল। তবে মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলোর বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন এমন একটি রোগের সন্ধানে আছে, যেটি মেক্সিকোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্ত বন্ধ করার পরিকল্পনাকে ন্যায্যতা দিতে সহায়তা করবে।
মাদক চক্র শ্রেণিবদ্ধকরণ
ডোনাল্ড ট্রাম্প মাদক চক্রগুলোকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আল-কায়েদা, তথাকথিত ইসলামিক স্টেট এবং হামাসের মতো গোষ্ঠীগুলোর তালিকায় এসব চক্রকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
সীমান্তপ্রাচীর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন
২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তখন তিনি সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের জন্য একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছিলেন। প্রাচীরটির একটি অংশ নির্মাণ করা হলেও এখনো বড় একটি অংশ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। ট্রাম্প হয়তো এবার সেই কাজ শেষ করতে পারেন।
ক্রিপ্টো মজুত
ট্রাম্প সব সময় ক্রিপ্টোকারেন্সির পক্ষে ছিলেন। তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর বিটকয়েনের দাম ৩০ শতাংশ বেড়েছে। অনেকের বিশ্বাস, বিটকয়েনের একটি কেন্দ্রীয় মজুত গড়ে তোলার জন্য ট্রাম্প খুব দ্রুত পদক্ষেপ নেবেন। এটি হবে যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তেল ও সোনার মতো একটি কৌশলগত মজুত। ট্রাম্পের ভাষ্য, মার্কিনদের উপকারে এটি স্থায়ী জাতীয় সম্পদ হিসেবে কাজে লাগবে।
জলবায়ু নীতি
বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পরিবেশবান্ধব কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও অবকাঠামো তহবিলের জন্য বেশ কিছু নির্দেশনা, আইন ও তহবিল কর্মসূচি পরিচালনা করেছেন। এটিকে তিনি তার বড় অর্জনগুলোর একটি হিসেবে দেখেন।
ট্রাম্প স্পষ্ট করেছেন, বাইডেনের নেওয়া এসব পদক্ষেপের বেশির ভাগই বাতিল করতে চান তিনি। অফশোর ও কেন্দ্রীয় ভূমিতে খননসংক্রান্ত বিধিনিষেধ প্রত্যাহারে ট্রাম্প নির্বাহী আদেশ দিতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। নতুন বায়ু–বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং বৈদ্যুতিক গাড়ির আদেশ বাতিল করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন ট্রাম্প।
ক্যাপিটল হিলের দাঙ্গায় বন্দি ১৫০০ জনকে ক্ষমা
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পরপরই নিজের প্রায় ১৫০০ সমর্থককে কারামুক্ত করার জন্য এক নির্বাহী আদেশে সই করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গার পর শত শত মানুষকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমি তাদের অনেককেই ক্ষমা করতে আগ্রহী। তবে প্রত্যেকের জন্য এ কথা বলতে পারছি না। কারণ, তাদের মধ্যে দুই-একজন সম্ভবত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল।’
ওই হামলায় যুক্ত থাকার অভিযোগে দেড় হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এর মধ্যে অন্তত ৬০০ জনের বিরুদ্ধে হামলা এবং কেন্দ্রীয় কর্মকর্তাদের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল।
ইউক্রেন যুদ্ধ থামানো
ট্রাম্প নির্বাচনি প্রচারাভিযানের সময় দাবি করেছিলেন, তিনি প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হওয়ার প্রথম দিনেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটাবেন। যুদ্ধ বন্ধে তার ছয় মাস সময় লাগতে পারে। তবে যুদ্ধ বন্ধে প্রথম দিনগুলোয় কী পদক্ষেপ নেবেন, এখনো তা স্পষ্ট নয়। শপথ নেওয়ার দিন ট্রাম্প বলেছেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি যুদ্ধ বন্ধে চুক্তিতে পৌঁছাতে চান।
গর্ভপাত বিষয়ক বিধি পুনর্বহাল
আগের বেশির ভাগ রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের মতো ট্রাম্প ‘মেক্সিকো সিটি নীতি’ পুনর্বহাল করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এর ফলে গর্ভপাতবিষয়ক পরামর্শ সেবাদাতা আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলোকে কেন্দ্রীয় সহায়তা দেওয়া নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। তিনি একটি গর্ভপাতবিষয়ক বিধিও পুনর্বহাল করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এর ফলে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সরবরাহকারী এবং নিম্ন আয়ের পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির আওতায় রোগীদের কাছে গর্ভপাতের কথা বলা যাবে না।
খেলাধুলায় ট্রান্সজেন্ডারদের নিষেধাজ্ঞা
ট্রাম্প বারবার স্কুল ও স্বাস্থ্যসেবায় ট্রান্সজেন্ডারদের অংশগ্রহণের সমালোচনা করে এটিকে ‘ট্রান্সজেন্ডার পাগলামি’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। বিশেষ করে ট্রান্সজেন্ডারদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ থেকে নিষিদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
চালু করেছেন টিকটক
টিকটক নিয়ে ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশে সই করেছেন। এতে চীনা মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটক নিষিদ্ধ করার আইন স্থগিত হলো। এর আগে টিকটকের ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞার পক্ষে ছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু সম্প্রতি তিনি তার অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। বলেছেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় টিকটকে তার ভিডিওগুলো কোটি কোটি বার দেখা হয়েছে।