এবিএনএ: মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত পরিবারের যারা শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম, এমন ব্যক্তিরা সাধারণত হজ পালন করতে যান। করোনা মহামারীতেও হজের খরচ এতটা ছিল না। চলতি বছর হজের ব্যয় মধ্যবিত্তের সামর্থ্যওে হিমশিম খেতে হচ্ছে। হজ পালনের প্যাকেজ (ব্যয়) ঘোষণার পর থেকে অনেকে সিদ্ধান্তহীনতায় আছেন হজে যাওয়া নিয়ে। যে কারণে প্রাকনিবন্ধন করেও এখন চূড়ান্ত নিবন্ধনে সাড়া মিলছে না। এর মধ্যে নিবন্ধনের সময় বাড়ানো হয়েছে তৃতীয় দফায়। তবে ব্যয় হ্রাসের কোনো ঘোষণা নেই কর্তৃপক্ষের। হজ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের দাবি- এখনো চাইলে সরকার ব্যয় হ্রাসের উদ্যোগ নিতে পারে। তাদের মতে, বিমান ভাড়া হ্রাস হলেই অনেক হজযাত্রী বেড়ে যাবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ করার ব্যয় ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৮ টাকা। অর্থাৎ গত বছরের চেয়ে এবার উভয় প্যাকেজেই বেড়েছে প্রায় দেড় লাখ টাকা।
অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) তথ্যানুযায়ী, গত সাত বছরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স হজের বিমান ভাড়া বাড়িয়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ। ২০১৭ সালে এই ভাড়া ছিল ১ লাখ ১৮ হাজার ৭৩৭ টাকা, ২০১৮ সালে ১ লাখ ২৮ হাজার টাকা, ২০১৯ সালে ১ লাখ ২৮ হাজার, ২০২০ সালে ১ লাখ ৩৮ হাজার এবং ২০২২ সালে ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা (২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে কেউ হজে যাননি)। সবশেষ ২০২৩ সালের জন্য হজযাত্রীর ফ্লাইট ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। গত বছরের তুলনায় এবারের প্রতি ফ্লাইটে ৫৮ হাজার টাকা ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে।
হজে গমনেচ্ছু কয়েক যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই বছর আগে তারা প্রাকনিবন্ধন করেছেন হজের জন্য। কিন্তু এবার যে ব্যয় নির্ধারণ (প্যাকেজ) করা হয়েছে, এতে তাদের অনেকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন। তাদের মতে, সরকারি-বেসরকারি হজ প্যাকেজে প্রায় সাত লাখ টাকার মতো খরচ ধরা হলেও পশু কোরবানি ও খাবারের খরচসহ মোট ৮ থেকে সাড়ে ৮ লাখ টাকা লেগে যাবে। দেশে বর্তমান পরিস্থিতিতে একজন হজে গিয়ে এ পরিমাণ টাকা ব্যয় করলে অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য হিমশিম খেতে হবে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যদিও বলা হচ্ছে- সব কিছুর ব্যয় বেড়েছে। মুদ্রার মানের তারতম্য ঘটছে। এসবের মধ্যেও কিন্তু অনেক দেশে হজের ব্যয় আমাদের দেশের তুলনায় কম।
হজ গমনেচ্ছুদের কথার রেশ ধরে হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মাওলানা ইয়াকুব শরাফাতি গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় বলেন, হজের এমন খরচ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ অস্বাভাবিক বিমান ভাড়া। যৌক্তিক কারণ ছাড়া ভাড়া বাড়িয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। তিনি বলেন, তৃতীয় পক্ষ এভিয়েশন টেকনিক্যাল কমিটির মাধ্যমে যৌক্তিক ভাড়া নির্ধারণের দাবি জানিয়ে আসছি আমরা। কিন্তু সেটি করা হয়নি। নিবন্ধন সময় এখনো আছে, আশা করছি কোটা পূর্ণ হয়ে যাবে। তবে কর্তৃপক্ষ চাইলে এখনো ব্যয় হ্রাসের উদ্যোগ নিতে পারে। এতে অনেক হজযাত্রী বেড়ে যাবে।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ পোর্টালের গত মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৫টার তথ্যানুযায়ী, সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৯ হাজার ২৫৩ জন এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৫৭ হাজার ৫৫৭ হজযাত্রী নিবন্ধন করেছেন। এখনো কোটার অর্ধেকের বেশি খালি রয়েছে।
সৌদি আরবের সঙ্গে হজ চুক্তি অনুযায়ী, এবার বাংলাদেশ থেকে এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজ করতে পারবেন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৫ হাজার জন ও অবশিষ্ট এক লাখ ১২ হাজার ১৯৮ জন বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ করার সুযোগ পাবেন।কোটার অর্ধেকও পূরণ না হওয়ায় চলতি বছর হজে যেতে হজযাত্রী নিবন্ধনের সময় তৃতীয় দফায় ৯ দিন বাড়ানো হয়েছে। নিবন্ধনের সময় আগামী ১৬ মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
তৃতীয় দফায় চূড়ান্ত নিবন্ধনের সময় বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মতিউল ইসলাম বলেন, নিবন্ধনের সময় ৭ মার্চ পর্যন্ত ছিল। আমরা আগামী ১৬ মার্চ পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে দিয়েছি। এর মধ্যে যদি কোটা পূরণ না হয়, তাতেও কোনো সমস্যা নেই। আমরা সৌদি আরবকে আগেই জানিয়ে দেব। চূড়ান্ত নিবন্ধনে কাক্সিক্ষত সাড়া না পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নানাবিধ কারণ হতে পারে। অনেকে এ বছর না গিয়ে আগামী বছর যাবেন। কেউ আর্থিক বিষয়ে প্রস্তুতি না থাকায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারেন। তবে অনেক দেশের হজযাত্রীর কোটা পূরণ হবে না। আগেও এমনটি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমাদেরও কোনো সমস্যা হবে না।
এদিকে হজ ব্যবস্থাপনায় খরচ কমাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট ধর্ম মন্ত্রণালয়কে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে। নোটিশে চলতি মৌসুমে নির্ধারণ করা হজের খরচ ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৮ টাকা থেকে কমিয়ে ৪ লাখ টাকার মধ্যে পুনর্নির্ধারণ করতে অনুরোধ করা হয়েছে। গত ৬ মার্চ ধর্ম মন্ত্রণালয়কে এ লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও আল কোরআন স্ট্যাডি সেন্টার সুপ্রিমকোর্টের কো-অর্ডিনেটর অ্যাডভোকেট আশরাফ-উজ্-জামান।
উল্লেখ্য, গত ৮ ফেব্রুয়ারি হজযাত্রী নিবন্ধন শুরু হয়; ২৩ ফেব্রুয়ারি নিবন্ধন শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নিবন্ধনে সাড়া না পাওয়ায় পরে সময় আরও পাঁচ দিন বাড়িয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করা হয়। এর পরও নিবন্ধনের হার ছিল খুবই কম। পরে নিবন্ধনের শেষ সময় বাড়িয়ে ৭ মার্চ করা হয়। কিন্তু কোটার বিপরীতে এখনো অর্ধেক হজযাত্রীও নিবন্ধিত হয়নি।
ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সরকারি ব্যবস্থাপনা এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনার হজযাত্রী নিবন্ধনের সময়সীমা আগামী ১৬ মার্চ পর্যন্ত চূড়ান্ত ও শেষবারের মতো বর্ধিত করা হলো। সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রাকনিবন্ধনের সর্বশেষ ক্রমিক পূর্বের সিরিয়াল বহাল রেখে ৪৫ হাজার ৬০৫ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হলো।
পাশাপাশি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রাকনিবন্ধনের সর্বশেষ ক্রমিক পূর্বের সিরিয়াল বহাল রেখে ৮ লাখ ৮৬ হাজার ১৯০ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হলো। কোটা পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিবন্ধন সার্ভার স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। নিবন্ধনের সময় আর বাড়ানো হবে না।
নিবন্ধন ভাউচার প্রস্তুতের পরবর্তী ২ (দুই) কার্যদিবসের মধ্যে অর্থ ব্যাংকে জমা দিয়ে নিবন্ধন নিশ্চিত না করলে ওই ভাউচার স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। আগামী ১৬ মার্চে হজ কার্যক্রম পরিচালনাকারী সব ব্যাংককে অফিস সময়ের পরও প্রস্তুতকৃত ভাউচারসমূহের অর্থ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত ব্যাংকের শাখাসমূহ খোলা রাখার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে চলতি বছরের ২৭ জুন (৯ জিলহজ) পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হবে।