আমেরিকালিড নিউজ

যেসব কারণে মার্কিন-চীন উত্তেজনা চরমে

এবিএনএ : বিশ্বের বৃহৎ দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের মধ্যকার কয়েক দশকের কথিত ‘কৌশলগত অংশীদারত্ব সম্পর্ক’ যে এখন সংকটের তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ গতকাল যুক্তরাষ্ট্র টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের হিউস্টোনে অবস্থিত চীনের কনস্যুলেট বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে বেইজিংকে।

শুধু একটি নয়, নানা কারণে এই দুই দেশের সম্পর্ক এখন এমন যে যুক্তরাষ্ট্র শুধু একা নানাভাবে বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যায়নি, আরও অনেক দেশকে নিয়ে চীনবিরোধী জোট গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে। চীনকে একঘরে করতে চাইছে ওয়াশিংটন। আর যেসব কারণে এই দ্বৈরথ, তার মূল কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো।

গত বছরের শেষদিকে চীনের উহান শহর থেকে বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। কিন্তু ভাইরাসের উৎপত্তি যথাসময়ে না জানানো এবং এ সংক্রান্ত তথ্যের অস্বচ্ছতার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরু থেকেই বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে আসছেন। তিনি করোনার নামকরণ করেছেন চীনা ভাইরাস।

ট্রাম্প বলছেন, ভাইরাসের উৎপত্তিসহ অন্যান্য তথ্য জাতিসংঘকে জানানোর যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, চীন তা না করে বরং চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে দিয়ে বিশ্বকে ভুল পথে চলতে বাধ্য করেছে। যে ভাইরাস বিশ্বের দেড় কোটি মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়ে ৬ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়েছে।

তবে চীন বলছে, তারা স্বচ্ছতার সঙ্গে ভাইরাসের ব্যাপারে তথ্য দিয়েছে। এছাড়া চীন ভাইরাস নিয়ে ভুল তথ্য দিয়েছে বলে ট্রাম্পের তোলা অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও। এরপর প্রথমে ডব্লিউএইচওর তহবিল বন্ধ করেন ট্রাম্প। ঘোষণা দেন সংস্থাটি ছাড়ার, যা আগামী বছরের মাঝামাঝি কার্যকর হবে।

বাণিজ্য যুদ্ধ
নিজেদের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার চীন থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর ২০১৮ সালে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে ট্রাম্প প্রশাসন। চীনের রাষ্ট্রীয় উৎপাদনের ওপর ভর্তুকি বাতিল এবং চীনে মার্কিন কোম্পানিগুলোর চাহিদা বৃদ্ধি করতে বেইজিংকে বাধ্য করার উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, উভয় পক্ষ জানে, চীন তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারবে না। ফলে বাণিজ্য বিরোধ মেটার সম্ভাবনা কম। এদিকে চীনের সঙ্গে উত্তেজনা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোকে চীন থেকে কারখানা সরিয়ে অন্যত্র নেওয়া এবং কাচামালের বিকল্প খোঁজার চাপ দিচ্ছে।

দক্ষিণ চীন সাগর
দক্ষিণ চীন সাগরে নিজেদের সামরিক উপস্থিত জোরদার করে গত কয়েক সপ্তাহে সেখানে বিরল সামরিক মহড়া চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। চীন দক্ষিণ চীন সাগরের জ্বালানি সমৃদ্ধ এলাকায় চীন তাদের সামুদ্রিক সাম্রাজ্য গড়ার অবৈধ অভিলাষ নিয়ে আগাচ্ছে বলে অভিযোগ তুলে আসছে ওয়াশিংটন। তারা অঞ্চলটির নিরাপত্তার কথা তুলেছে।

সাগরটির ৯০ শতাংশ নিজেদের বলে বেইজিং যে দাবি করছে তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন্স, তাইওয়ান এবং ভিয়েতনাম। গত ১৩ জুলাই এক বিবৃতিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও চীনের এমন দাবিকে বেআইনি বলে অভিহিত করেছে। এর আগে এমন অভিযোগ কখনও তোলেনি দেশটি।

হংকং
হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থীদের বিক্ষোভ নিয়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সম্প্রতি চীন হংকংয়ে বিতর্কিত জাতীয় নিরাপত্তা আইন চালু করায় এর তীব্র বিরোধিতা করছে ওয়াশিংটন। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সাবেক ব্রিটিশ কলোনি হংকংকে ২০৪৭ সাল পর্যন্ত স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি চীন লঙ্ঘন করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

চীনের এমন প্রহসনমূলক আইন কার্যকরের প্রতিক্রিয়ায় হংকংকে দেওয়া অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা বাতিল করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ সংক্রান্ত নির্বাহী আদেশে সই করেছেন ট্রাম্প; যা তাকে চীনা কর্মকর্তা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পথ তৈরি করে দিয়েছে। চীনও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছে।

উইঘুর মুসলিম নির্যাতন
জিনজিয়াং প্রদেশে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত নির্যাতন চালানোর মাধ্যমে চীন যে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে তার প্রতিবাদে চীনের বিভিন্ন কর্মকর্তা, কোম্পানি এবং প্রতিষ্ঠান-সংস্থার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়েও দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে সম্প্রতি।

জিনজিয়াংয়ে বন্দিশিবির তৈরি করে কথিত পুনঃশিক্ষা কার্যক্রমের নামে উইঘুরদের বিরুদ্ধে চীন যে ব্যাপক নির্যাতন চালাচ্ছে তার প্রতিবাদ বিশ্বজুড়েই হচ্ছে। চীন উইঘুর নারীদের জোরপূর্বক জন্মনিয়ন্ত্রণে বাধ্য করছে। তাদেরকে নানাভাবে নির্যাতন চালিয়ে তাদের ধর্ম থেকে বিচ্যুত করে নতুন শিক্ষা দেওয়ার কাজ করছে চীন।

হুয়াওয়ে
দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির আরেকটি বড় কারণ চীনা প্রযুক্তি জায়ান্ট হুয়াওয়ে। জাতীয় নিরাপত্তা শঙ্কা ও গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে হুয়াওয়েকে নিষিদ্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন বলছে, ইরানে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন ও গ্রহকদের মাধ্যমে গুপ্তচরবৃত্তি করছে কোম্পানিটি। কিন্তু হুয়াওয়ে এমন অভিযোগ অস্বীকার করছে।

নিষেধাজ্ঞার কারণে হুয়াওয়ে চিপ ছাড়াও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিপণ্যগুলো যুক্তরাষ্ট্রে সরবরাহ করতে পারবে না। হুয়াওয়ে বলছে, নিজেদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে হতাশ যুক্তরাষ্ট্র। কারণ আমরা যে মূল্যে এসব পণ্য সরবরাহ করছি কোনো মার্কিন কোম্পানি ওই মূল্যে এসব প্রযুক্তি দিতে পারছে না। এটাই হলো বড় কারণ।

শুধু নিজেরা নয় বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোকেও হুয়াওয়েকে বর্জন করার চাপ দিচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন। সেই চাপে পড়ে সম্প্রতি যুক্তরাজ্য হুয়াওয়ের পণ্য ব্যবহারের বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে আরও অনেক দেশ একই পথে রয়েছে। চীন সরকার বলছে, তাদের কোম্পানির স্বার্থ রক্ষায় সম্ভাব্য সবকিছু করবে তারা।

চীনা সাংবাদিক ও শিক্ষার্থী
চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যমগুলোকে দূতাবাস হিসেবে দেখা শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করে এমন এক থেকে দেড় শতাধিক গণমাধ্যমের অনেক সাংবাদিকের যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করার অনুমতি তুলে নিয়েছে ওয়াশিংটন। বেইজিংও চীনে কাজ করছেন এমন কয়েক ডজন মার্কিন সাংবাদিককে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেছে।

এছাড়া দুই দেশের এমন দ্বৈরথে পড়েছেন চীনা শিক্ষার্থীরাও। চীনের স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়মনীতি আরও কঠোর করেছে ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করছে এমন অনেক শিক্ষার্থী চীনের সামরিক বাহিনীর হয়ে কাজ করে বলেও অভিযোগ তোলা হচ্ছে। এসবও প্রভাব ফেলেছে উত্তেজনা বৃ্দ্ধিতে।

উত্তর কোরিয়া
যদিও চীন যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশই উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র পাওয়া ঠেকানোর বিষয়টিতে একই অবস্থানে রয়েছে তথাপি দুই দেশের মধ্যে উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে মতপার্থক্য আছে। উত্তর কোরিয়ার ওপর জাতিসংঘ আরোপিত নিষেধাজ্ঞা চীন লঙ্ঘন করছে বলে অভিযোগ করে ওয়াশিংটন। অবশ্য বেইজিং তা অস্বীকার করে।

চীন চায় উত্তর কোরিয়ার ওপর আরোপিত কিছু নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হোক কিন্ত তাতে রাজি নয় যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন তিনবার বৈঠক করেও পিংইয়ংয়ের পারমাণবিক অস্ত্র প্রকল্প বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের দাবি এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে উত্তর কোরিয়ার দাবির কোনো উন্নতি করতে পারেনি।

Share this content:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button