বাংলাদেশরাজনীতিলিড নিউজ

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের ফের সংলাপ

এবিএনএ: গণভবনে আগামীকাল বেলা ১১টায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে ফের সংলাপ হবে। এদিনের সংলাপকে সমঝোতার শেষ চেষ্টা হিসেবে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ বাতিল, আলোচনা করে নিরপেক্ষ সরকার গঠন’ এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ রাজবন্দিদের মুক্তি এ দুটি ইস্যুতে অনড় থাকতে পারেন ঐক্যফ্রন্ট নেতারা।

নতুন এ জোটের সাত দফার গুরুত্বপূর্ণ দাবি দুটি ক্ষমতাসীনদের মেনে নেয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। তারপরও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে কতটা ছাড় দেয়া যায় তা নিয়ে দুই পক্ষই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন।

অবশ্য কিছুটা ছাড় দিয়ে যৌক্তিক সমাধানে পৌঁছার চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা। কাল অনুষ্ঠেয় স্বল্প পরিসরে এ সংলাপে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব দেবেন ড. কামাল হোসেন।

সূত্র জানায়, সংসদ ভেঙে দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা হলেও নির্বাচনে যেতে আপত্তি নেই ঐক্যফ্রন্টের। অন্যদিকে সংসদ না ভেঙে নির্বাচনকালীন সরকারে ঐক্যফ্রন্টকে যুক্ত করতে চাইছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তাকে নির্বাচনের সুযোগ দেয়ার জোর দাবি ফ্রন্টের।

পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে নমনীয় হলেও তাকে নির্বাচনের সুযোগ না দেয়ার পক্ষে। অংশটুকু তাদের এখতিয়ারবহির্ভূত। এ বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্ত লাগবে।

নেতাদের অবস্থান যাই হোক বুধবারের সংলাপে বসেই চূড়ান্ত সমঝোতায় আসতে হবে। অন্যথায় বৃহস্পতিবার তফসিল ঘোষণা হলে পেছনের দিকে তাকানোর সুযোগ থাকবে না নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক দলগুলোর।

সূত্র জানায়, একটি সহজ ও গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানের পথ খুঁজছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সংবিধানের ভেতরে থেকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ন্যায়সঙ্গত দাবি পূরণে রাজি দলটি।

তবে এর জন্য শর্ত ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট ৭ দফা দাবিতে নমনীয় হতে হবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের। ফ্রন্ট নেতাদের নির্বাচন নিয়ে ছাড় দেয়ার মানসিকতা থাকলে আগামীকালের ছোট পরিসরের সংলাপেই সেই সমঝোতার জট খুলে যেতে পারে।

‘একটি সুন্দর সমঝোতা হবে’- এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, শর্ত ও স্বার্থ উভয় পক্ষ বিসর্জন না দিলে সমঝোতা হয় না।

একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে ছাড় দিতে হবে। গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ নিতে হবে। এর জন্য সরকারি দলের উচিত হবে জনগণের মতামতকে বেশি প্রাধান্য দেয়া। আগামীকালের সংলাপে একটি সমঝোতা হবে বলে দেশবাসীর প্রত্যাশা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কতটা ছাড় দেবে সেদিকেই সবার নজর। সংকট সমাধানে দুই পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে বলে তারা মনে করছেন। তাদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিতে অনেক কিছুই ইতিবাচক মনে হচ্ছে।

দুই পক্ষকেই ছাড় দেয়ার মানসিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সংবিধানের ভেতর থেকে সমাধান বের করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ঐক্যফ্রন্ট যদি সংবিধানের ভেতর থেকে যৌক্তিক দাবি দেয় তবে তা ভেবে দেখা হবে। সে বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।

আলোচনায় ছাড় দেয়ার পাশাপাশি ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশে অনুমতি দেয়াকেও ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন তারা। সব মিলিয়ে রাজনীতিতে একটা সমঝোতা হবে, এমনটাই মনে করছেন তারা।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি আদালতের এখতিয়ার। তবে তার প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিএনপি নেতারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন। এ ব্যাপারে আলোচনার পথ খোলা।

কাদের বলেন, সংলাপ হওয়াটাই রাজনীতিতে একটি ইতিবাচক অগ্রগতি। তাছাড়া সংলাপ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী খুবই আন্তরিক। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা ছোট পরিসরে বসতে চেয়েছেন। আমাদের নেত্রী রাজি হয়ে গেছেন।

তারা প্রথম সংলাপে সভা-সমাবেশের কথা বলেছেন। এখন বাধাহীন সভা-সমাবেশ করছেন। তারা রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের কথা বলেছেন। সে বিষয়টিও মেনে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আমরা আশা করব জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতারা বুধবারের আলোচনায় সমঝোতায় আসবেন।

জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে আমরা সাত দফা দাবি জানিয়েছি। এ ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে আমরা সংলাপও করেছি। কিন্তু আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দাবি মেনে নিতে তারা আন্তরিকতা দেখাননি।

তিনি বলেন, এক বসায় সবকিছু হয়ে যাবে বলে আমরা মনে করি না। সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ফের বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। স্বল্প পরিসরের ওই বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।

সরকার যদি একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার প্রতিশ্র“তি দেয় এবং সত্যিই তা করতে চায় তাহলে দাবির ক্ষেত্রে আমরা কিছু ছাড়ও দিতে পারি। দেশের স্বার্থে দু’পক্ষকেই একটি যৌক্তিক সমঝোতায় আসতে হবে।

১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের প্রথম দফার বৈঠকে কাক্সিক্ষত সমাধান না পাওয়ায় ফের সংলাপ চেয়ে রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দেন ড. কামাল হোসেন। চিঠিতে ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফার সাংবিধানিক ও আইনগত দিক বিশ্লেষণের জন্য উভয় পক্ষের বিশেষজ্ঞসহ সীমিত পরিসরে আলোচনা করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়।

ড. কামালের চিঠি পেয়ে রাতেই সংলাপে বসার ব্যাপারে ক্ষমতাসীনরা ইতিবাচক জবাব দেন। বুধবার সকালে সংলাপে বসার সময় দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সংলাপের সময় পাওয়ার পর করণীয় নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেন ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। সংবিধানের ভেতর থেকে সমাধান বের করতে নিজেরা ছাড়াও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়া হয়।

আওয়ামী লীগ বরাবরই বলে আসছে, সংবিধানের বাইরে যাওয়া যাবে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঐক্যফ্রন্ট মনে করছে, সংবিধানের মধ্যে থেকেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের একাধিক পথ খোলা আছে। সরকার আন্তরিক হলে ঐক্যফ্রন্ট সংলাপে বসে বড় ধরনের ছাড় দিতে প্রস্তুত। প্রয়োজনে বর্তমান সংবিধানমতে প্রধানমন্ত্রীর অধীনেও নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে তাদের মধ্যে আলোচনা আছে।

সে ক্ষেত্রে সংসদ ভেঙে দিয়ে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে হবে সেখানে সব নিবন্ধিত দলের সমন্বয়ে প্রতিনিধি থাকবে। ওই সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা হলেও তাদের আপত্তি থাকবে না।

বিএনপিকে স্বরাষ্ট্রসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় দিতে হবে। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখেও নির্বাচনে যাবে দলটি। তবে চেয়ারপারসনকে নির্বাচন করার সুযোগ দিতে হবে।

আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা যায়, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে তখনই রাজনৈতিক সমঝোতা হবে যখন তাদের সাত দফার প্রথম দাবি- ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ বাতিল, আলোচনা করে নিরপেক্ষ সরকার গঠন’ থেকে সরে আসবে।

বাকি দাবির মধ্যে- ‘খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার’ বিষয়ে রাজনৈতিক সমঝোতায় ইতিবাচক মনোভাব দেখাতে পারে ক্ষমতাসীনরা। তবে এ নিয়ে কালক্ষেপণের সুযোগ নেই। বুধবারের সংলাপে বসেই চূড়ান্ত সমঝোতা আসতে হবে।

সূত্র জানায়, দাবি আদায়ের আগে সংলাপে ঐক্যফ্রন্টকে প্রতিশ্র“তি দিতে হবে, তারা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে। নির্বাচন বানচালের মতো কোনো কর্মসূচিতে যাবে না। সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ বজায় রেখে কাজ করবে।

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে আপত্তি না থাকলেও তার নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি মেনে নেয়ার সুযোগ নেই আওয়ামী লীগের। কারণ বিষয়টি সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ারভুক্ত।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের আরেকটি সূত্র বলছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতারা চাইলে নির্বাচনকালীন সরকারে থাকার বিষয়টিও আলোচনায় আসতে পারে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী টেকনোক্রেট কোটায় তাদের তিনটি মন্ত্রণালয় দিতে পারেন।

বুধবারের সংলাপেই তা সমঝোতা হলে পরদিনই মন্ত্রিসভা রদবদল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এর বাইরে সভা-সমাবেশ করার বিষয়টি প্রথমদিনের সংলাপেই মেনে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এটি এরই মধ্যে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জোটটির সমাবেশের অনুমতি চাওয়া মাত্রই পেয়েছে। বিদেশি পর্যবেক্ষক দাবিও মানা হয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতায় সেনা মোতায়েনে কোনো ছাড় দেবে না আওয়ামী লীগ।

তাহলে ফের সংলাপ কেন- এমন প্রশ্নে আওয়ামী লীগের এই শীর্ষ নেতা বলেন, প্রধানমন্ত্রী চান, আগামী নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করুক। সংবিধানের মধ্যে থেকে তাদের আরও কোন দাবিতে একমত হওয়া গেলে আপত্তি নেই। বরং সবার সন্তুষ্টি নিয়ে সুন্দর একটি নির্বাচন উপহার দেয়াই প্রধানমন্ত্রীর লক্ষ্য।

Share this content:

Back to top button