একুশের বইমেলায় প্রাণের স্পন্দন

ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার জন্য বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দিয়েছিলেন সালাম, রফিক, বরকতসহ আরও অনেকে। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বসভার স্বীকৃতি লাভ করেছে। ভাষা শহীদদের সম্মান এবং বাংলা সাহিত্যের চর্চা-প্রচার-প্রসারের জন্য ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ থেকে ঢাকায় বইমেলার আয়োজন করা হয়, যা অমর একুশে গ্রন্থমেলা নামেই পরিচিত। এবারও ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে অমর একুশে বইমেলা। মহান ভাষা আন্দোলনের চেতনায় ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালি জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক মহতী প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি।
বইমেলার ইতিহাস
মেলার ইতিহাস স্বাধীন বাংলাদেশের মতোই প্রাচীন। যতদূর জানা যায়, ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। এই ৩২টি বই ছিল চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমান মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশী শরণার্থী লেখকদের লেখা বই। এই বইগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি একাই বাংলা একাডেমি চত্বরে বইয়ের পসরা নিয়ে বসতেন। ১৯৭৬ সালে অন্যরা অনুপ্রাণিত হন। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক ড. আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। এই সংস্থাটিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়। সেই ৩২টি বইয়ের ক্ষুদ্র মেলা কালানুক্রমে বাঙালির সবচেয়ে বড় বইমেলায় পরিণত হয়েছে। বাংলা একাডেমি চত্বরে স্থান সংকুলান না-হওয়ায় ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হয়। ১৯৮০ সালে মেলার স্টল ছিল মাত্র ৩০টি। এখন স্টলের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। প্রতি বছরই মেলার দর্শক, পাঠক ও লেখকের সংখ্যা বাড়ছে।
মেলার পরিসর
অমর একুশে গ্রন্থমেলা বসেছে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং একাডেমির বিপরীত দিকে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রায় চার লাখ বর্গফুট জায়গায়। এবার অমর একুশে গ্রন্থমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশকে ১২টি চত্বরে সজ্জিত করা হয়েছে। একাডেমি প্রাঙ্গণে ৮০টি প্রতিষ্ঠানকে ১১৪টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৩২৯টি প্রতিষ্ঠানকে ৫৪৯টি ইউনিট; মোট ৪০৯টি প্রতিষ্ঠানকে ৬৬৩টি ইউনিট এবং বাংলা একাডেমিসহ ১৫টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে মোট ৬ হাজার বর্গফুট আয়তনের ১৫টি প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ১০০টি লিটল ম্যাগাজিনকে বর্ধমান হাউসের দক্ষিণ পাশে ‘লিটল ম্যাগাজিন কর্নারে’ স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র প্রকাশনা সংস্থা এবং ব্যক্তি উদ্যোগে যারা বই প্রকাশ করেছেন তাদের বই বিক্রি ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকবে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের স্টলে। গ্রন্থমেলায় বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বই ৩০ শতাংশ কমিশনে এবং মেলায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ২৫ শতাংশ কমিশনে বই বিক্রি করবে। একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রয়েছে বাংলা একাডেমির ২টি প্যাভিলিয়ন, একাডেমির শিশু-কিশোর প্রকাশনাভিত্তিক বিক্রয়কেন্দ্র এবং একাডেমির সাহিত্য মাসিক উত্তরাধিকারের বিক্রয়কেন্দ্র থাকবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জানা গেছে, ২০১৭ সালের এই গ্রন্থমেলা উপলক্ষে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করছে মোট ১০১টি নতুন বই। এবারও ‘শিশুকর্নার’ রয়েছে মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, প্রকাশকের সংখ্যা বেড়েছে, প্রত্যেকের প্রত্যাশা, মেলায় বড় স্টল পাবে। তাছাড়া গত বছর ৩৫২টি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করেছিল। এবার প্রায় ৪৫০ প্রতিষ্ঠান প্রকাশক অংশগ্রহণ করছেন। এ মেলায় দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ আসে। এমনকি প্রবাসীরাও আসেন একুশে বইমেলায় অংশ নিতে। সে কারণে মেলার পরিধি বাড়াতে হয়েছে।
প্রতিদিন মেলা শুরু হয় বিকাল তিনটায়। চলে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত। প্রতি সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার মেলা বেলা ১১টা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত চলে। শুক্র ও শনিবার বেলা ১১টা থেকে একটা পর্যন্ত ‘শিশুপ্রহর’ ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
বই প্রকাশের নানা সমস্যা
বাংলাদেশের সৃজনশীল প্রকাশনা নানা সমস্যায় ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে। এই সমস্যা সবচেয়ে বেশি ঘণীভূত হয় বই সম্পাদনা ও উৎপাদিত বই বিপণনে। বাংলাদেশের সৃজনশীল প্রকাশকরা আর্থিক মানদণ্ডে বেশিরভাগ সময় ভারসাম্য বিন্দুর (ইৎবধশ ঊাবহঃ ঢ়ড়রহঃ) নিচে অবস্থান করেন। ফলে টিকে থাকার সংগ্রামে দহন হতে হতে উন্নয়নের দৌড়ে খুব একটা সফল হতে পারে না। এ বিষয়ে গবেষক ও প্রকাশক খান মাহবুব যুগান্তরকে বলেন, বই প্রকাশনার একটি অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে সু-সম্পাদিত করে মুদ্রণের ব্যবস্থা। আমাদের দেশের প্রকাশকদের দক্ষ সম্পাদক নেই। এর কারণ অবশ্য অনেক। প্রথম ও প্রধান কারণ হচ্ছে প্রকাশকদের আর্থিক সঙ্গতি নাজুক, ফলে স্বাদ থাকলেও সম্পাদক রাখার মতো সামর্থ্য নেই। আধুনিক বই উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কপি এডিটর, রিভিউ এডিটর, রিভিউয়ার, এডিটর- এসব ব্যক্তির মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে বই আকারে প্রকাশের জন্য একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সৃজনশীল প্রকাশকদের প্রকাশনা ফার্মে অনেকেরই একজন কপি এডিটরও নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শুধু বানান সংশোধকদের দিয়ে সংশোধনী কাজ সম্পন্ন করে পাণ্ডুলিপি হতে বই উৎপাদন করেন। গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানে এডিটিংয়ের ব্যবস্থা থাকলেও সার্বিক চিত্র হতাশাব্যঞ্জক। তিনি আরও জানান, আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে এদেশে ভালো এডিটিং ফার্মও গড়ে ওঠেনি। আমি মনে করি ভালো এডিটিং ফার্ম গড়ে উঠলে প্রকাশকরা অবশ্যই তাদের কাজের জোগান দেবেন। কারণ এতে করে দু’পক্ষেরই সুবিধা হবে। সম্পাদনার ব্যয় এতটাই অধিক যে এর প্রভাবে বইয়ের মুদ্রণ ব্যয় বেড়ে যাবে আংশকা করে প্রকাশক অনেক সময় সম্পদনার বিষয়টি এড়িয়ে যান। এই সমস্যার আরেকটি বড় কারণ হল লেখক বই উৎপাদনের জন্য আমাদের দেশে মোটেও সময় দিতে রাজি না। ফলে তড়িঘড়ি করে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অনেক সময় সম্পাদনার ক্ষেত্রে ঘাটতি থেকে যায়। আরেকটি অন্তর্গত সমস্যা হচ্ছে যথার্থ সম্পাদনার জন্য সম্পাদকও আমাদের সমাজে গড়ে ওঠেননি। তার বড় কারণ সম্পাদনা শেখার মতো ভালো কার্যক্ষেত্র নেই। পাশাপাশি এই কাজ শিখে ভালো ক্যারিয়ার গঠনের সুযোগও তৈরি হয়নি। লেখকরাও লেখালেখির মৌলিক কলাকৌশল রপ্ত না করেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন বলে পাণ্ডুলিপি তৈরি ও বিন্যাসে মৌলিক গলদ থেকেই যায়।
বইয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন
গত বছর বইমেলায় প্রায় চার হাজারের মতো বই প্রকাশ হয়েছিল। এবার এই সংখ্যা আরও বেশি হবে। এ প্রসঙ্গে একাডেমির মহাপরিচালক বলেন, অসংখ্য বই বের হলেও বইয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। এত সংখ্যক বইয়ের মধ্যে মাত্র একশো থেকে দেড়শো বই মানসম্মত। মান যে নিশ্চিত করা যাচ্ছে না এটা একটা বড় সমস্যা।
তিনি বলেন, মানের বিষয়টা পাঠকদের ওপর ছেড়ে দিয়েছি, তারাই মান নির্ণয় করবেন। একটা সমস্যার কথা শোনা যায়, বাইরে যারা থাকেন তারা কোনো কোনো প্রকাশকদের টাকা দিয়ে থাকেন, তারপর তাদের লেখা একটা বই ছাপিয়ে দেয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে বিদেশেও নতুন লেখকদের বই টাকা নিয়েই ছাপা হয়। কিন্তু সেখানে মান যাচাইয়ের ব্যবস্থা আছে, প্রকাশকদের সম্পাদনা পরিষদ আছে, ভাষা সম্পাদন করা হয়, পরিমার্জন করা হয়- এগুলো বাংলাদেশে নেই বলে মান যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না।
বিপণন সংকট
বইয়ের বিপণনের বিষয়ে গবেষক ও প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বইয়ের জগতে আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে বিপণনের। এদেশে একজন প্রকাশক পাণ্ডুলিপি থেকে বই প্রস্তুতের মতো সৃজনমনস্ক কাজ করেই রেহাই পায় না। তার উৎপাদিত পণ্যের বিপণনও তাকেই করতে হয়। বিপণনের জন্য কোনো ফার্ম বিস্তৃত পরিসরে গড়ে ওঠেনি। বিপণন চ্যানেলের অবস্থাও ভালো না। বইকে পাঠকের হাতে পৌঁছে দিতে পাঠ আন্দোলন গড়ে তোলার সরকারি ও বেসরকারি প্রয়াস যথেষ্ট নেই। সৃজনশীল উৎপাদিত বইয়ের একটা বড় অংশ দীর্ঘদিন প্রকাশকের গুদামে পড়ে থাকে। এতে পণ্য উৎপাদন ও বণ্টনের যে ঘূর্ণায়মান চক্র, তা ব্যাহত হয়। অর্থের প্রবাহের তারল্য ঘাটতিতে পতিত হয়ে প্রকাশক ক্ষতিগ্রস্ত হন। বিপণনের ক্ষেত্রে বই পরিবহন ও ডাক মাশুল উচ্চ। বই পরিবহনের সুবিধার জন্য হালকা ওজনের উন্নত মানের কাগজেরও স্বল্পতা রয়েছে বাংলাদেশের বাজারে। বিভিন্ন সময়ের সরকার বই ও প্রকাশনার সম্পর্কে অনেক স্তুতিবাক্য বললেও এদেশের প্রকাশনার সার্বিক উন্নয়নে লাগসই স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মকৌশল গ্রহণ করা হয়নি। এদেশে লোকসংখ্যার তুলনায় পাঠক সংখ্যা সন্তোষজনক নয়।
এবারের নতুন সংযোজন
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নতুন বিন্যাসে এবারের অধিকাংশ স্টল পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে আনা হয়েছে। টিএসসি ও দোয়েল চত্বরের মূল প্রবেশ পথে এলইডি মনিটর রয়েছে। এখান থেকে মেলা সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য/নির্দেশনা পাওয়া যাচ্ছে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ‘নতুন বইয়ের প্রদর্শনশালা’ করা হয়েছে। এতে প্রতিদিন প্রকাশিত নতুন বই দিনভিত্তিক সাজানো থাকবে। শারীরিক প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক মানুষের চলাচলের সুবিধার্থে হুইল চেয়ারের সংখ্যা গতবারের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে পর্যটন কর্পোরেশনের ১টি ক্যান্টিন এবং বাংলা একাডেমি অংশে পর্যটন কর্পোরেশনের ১টিসহ ২টি ক্যান্টিন চালু রয়েছে। বৃষ্টির কথা মাথায় রেখে স্টলগুলোতে টিনের ছাউনি দেয়া হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পর্যাপ্ত মাটি ফেলে জমি ভরাট করা হয়েছে। প্রায় ৮০ হাজার বর্গফুট এলাকায় ইট ও বালু দিয়ে অস্থায়ী রাস্তা/উন্মুক্ত প্রান্তর নির্মাণ করা হয়েছে। শিশুকর্নারে এবার নতুন সংযোজন ‘মাতৃদুগ্ধ সেবাকেন্দ্র’। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ‘মুক্তমঞ্চে’ নাটক মঞ্চায়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
Share this content: