অর্থ বাণিজ্যলিড নিউজ

ঋণ পাচ্ছেন খেলাপিরা, পরিচালক পদেও বহাল

এবিএনএ : ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করেননি। তাই আইন অনুযায়ী তাঁরা খেলাপি হয়ে গেছেন। ফলে নতুন করে ঋণ নেওয়ার এবং ব্যাংকের পরিচালক পদে থাকার যোগ্যতাও হারিয়েছেন। এরপরও তাঁরা পরিচালক পদে থেকে ব্যাংক পরিচালনা করছেন। তাঁদের কাউকে কাউকে আবার অন্য ব্যাংকগুলো উদারহস্তে ঋণ প্রদান করছে। এতে ঝুঁকিতে চলে যাচ্ছে আমানতকারীদের অর্থ। কমপক্ষে তিনজন ব্যাংক পরিচালকের ব্যাপারে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
তাঁরা তিনজন হলেন ঢাকা ব্যাংকের পরিচালক ও বিএনএস গ্রুপের কর্ণধার এম এন এইচ বুলু, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক আবদুল আওয়াল পাটোয়ারি ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালক কামরুন নাহার সাখী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঋণখেলাপি এই তিনজনই ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না। উপরন্তু আদালতের রিট আদেশ নিয়ে নিজেদের খেলাপি হওয়া দেখানো থেকে বিরত রাখার সুযোগ পেয়েছেন। ফলে খেলাপি হয়েও আর্থিক খাতে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন তাঁরা।

জানা গেছে, বিএনএস গ্রুপের কর্ণধার এম এন এইচ বুলু। তাঁর গ্রুপের সাতটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) পাওনা ৩৯৫ কোটি টাকা, যা বর্তমানে খেলাপি। আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে বুলু এখন ঢাকা ব্যাংকের পরিচালক। এরপরও ঝুঁকি নিয়ে সম্প্রতি বুলুর প্রতিষ্ঠানগুলোকে ১৩০ কোটি টাকা অর্থায়ন করেছে ন্যাশনাল ব্যাংক।
জানতে চাইলে ন্যাশনাল ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এস এম বুলবুল বলেন, ‘অন্য ব্যাংকের পরিচালক পদে থাকলে আমাদের ঋণ দিতে সমস্যা কী? খেলাপি হলে তো তাঁকে কেউ পরিচালক রাখত না।’
আদালতের নথি, ইউসিবি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১২ সালের ২৩ মে ও ১২ জুন বুলু ইন্টারন্যাশনাল, ঐশী এন্টারপ্রাইজ ও বিএনএস ইন্টারন্যাশনালের পক্ষে ঋণের জন্য আবেদন করেন এম এন এইচ বুলু। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ১৩ জুন ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সভায় তিন প্রতিষ্ঠানের নামে যথাক্রমে ৫০ কোটি, ৬০ কোটি ও ৫০ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর হয়। এসব ঋণের মঞ্জুরিপত্রে গ্রাহকের স্বাক্ষরও নেয় ব্যাংক। বুলুর স্বাক্ষরিত বিভিন্ন চেকের মাধ্যমে টাকা তুলে গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠানের হিসাবে জমা করা হয়। পরে ঋণের মেয়াদ শেষ হলেও তা পরিশোধ করা হয়নি। ২০১৪ সালের ৫ মে ব্যাংকে লেখা এক পত্রে বুলু জানান, বিভিন্ন সম্পত্তি বিক্রি করে ৩০ জুনের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করা হবে। একই বছরের ২৯ মে আরেক চিঠিতে সুদ মওকুফের জন্য আবেদন করেন বুলু। তবে ঋণ পরিশোধ না হওয়ায় ২০১৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর গ্রাহককে উকিল নোটিশ প্রদান করে ব্যাংক। উকিল নোটিশের জবাব না দিয়ে একই বছরের ১৫ অক্টোবর উল্টো ব্যাংকের বিরুদ্ধে প্রতারণা মামলা দায়ের করেন বুলু।
এম এন এইচ বুলুর কাছে ইউসিবি প্রিন্সিপাল শাখার পাওনা ৭২ কোটি টাকা, আলিফ এন্টারপ্রাইজের কাছে বসুন্ধরা শাখার পাওনা ২১ কোটি টাকা, ঐশী এন্টারপ্রাইজের কাছে তেজগাঁও শাখার পাওনা ৩২ কোটি টাকা, বিএনএস ইন্টারন্যাশনালের কাছে সোনারগাঁও পান্থপথ শাখার পাওনা ৬০ কোটি টাকা, বুলু ইন্টারন্যাশনালের কাছে মিরপুর শাখার পাওনা ৫৭ কোটি টাকা, সাত্তার এন্টারপ্রাইজের কাছে বনানী শাখার পাওনা ৫৭ কোটি টাকা এবং কবির এন্টারপ্রাইজের কাছে গুলশান শাখার পাওনা ৯৫ কোটি টাকা।
২০১৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে এক চিঠির মাধ্যমে এসব ঋণের দায় অস্বীকার করেন এম এন এইচ বুলু। ওই চিঠিতে বলা হয়, এসব ঋণের সুবিধাভোগী তিনি নন। অন্য কেউ ঋণ নিয়ে তাঁর ওপর দায় চাপাচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ পরিদর্শন করে। পরিদর্শন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক বুলুকে জানায়, ঋণের মঞ্জুরিপত্রে গ্রাহকের স্বাক্ষর রয়েছে।
একইভাবে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালক কামরুন নাহার সাখীও পরিচালক পদে রয়েছেন বহাল তবিয়তে। দেশের নয়টি ব্যাংক থেকে সিলভিয়া গ্রুপের নামে হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছেন গ্রুপটির শীর্ষ ব্যক্তিরা। ওই গ্রুপের পরিচালক কামরুন নাহার সাখীও। ঋণখেলাপি হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক কামরুন নাহারকে পরিচালক পদ থেকে সরিয়ে দিলেও আদালতের আদেশে তিনি পদে বহাল আছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, তাদের প্রতিষ্ঠান হলো মিশম্যাপ শিপব্রেকিং, ফয়জুন শিপব্রেকিং, বিআর স্টিল মিলস, মুহিব স্টিল অ্যান্ড শিপ রি-সাইক্লিং, এমআরএম এন্টারপ্রাইজ, এমআর শিপিং লাইনস, আহমেদ মোস্তফা স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ ও সানমার হোটেলস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পাওনা প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া অগ্রণী ব্যাংকের পাওনা ২২৩ কোটি, ব্যাংক এশিয়ার ১৫১ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৮৫ কোটি, ইস্টার্ণ ব্যাংকের ৪৮ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ৪৭ কোটি, ঢাকা ব্যাংকের ২৩ কোটি এবং শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের ৭ কোটি ও যমুনা ব্যাংকের ৫ কোটি টাকা।
সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক আবদুল আওয়াল পাটোয়ারিও ঋণখেলাপি হওয়ার পর পরিচালক পদে বহাল আছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠান পাটোয়ারি পটেটো ফ্ল্যাশের কাছে অগ্রণী ব্যাংকের পাওনা প্রায় ৭০ কোটি টাকা। এ ছাড়া বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক পাবে প্রায় ৩০ কোটি টাকা। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি সরকারের সম-উদ্যোক্তা মূলধন তহবিল (ইইএফ) থেকে ৩ কোটি টাকা মূলধন সহায়তা নেয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো অর্থ পরিশোধ করেনি প্রতিষ্ঠানটি। ঋণখেলাপি হওয়ায় পরিচালক পদ থেকে বাংলাদেশ সরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েও সফল হয়নি। আদালতের আদেশে নিজেকে খেলাপি দেখানো থেকে বিরত রাখার সুযোগ নিয়েছেন তিনি। বহাল আছেন সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক হিসেবেও।
আবদুল আওয়াল পাটোয়ারি বলেন, ‘ব্যাংক সময়মতো টাকা না দেওয়ায় আমি ব্যবসা করতে পারিনি। এখন টাকা শোধ করব কীভাবে?’

Share this content:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button