জাতীয়বাংলাদেশলিড নিউজ

‘আমাদের মেরে ফেলুন, নয়তো ওদের সঙ্গে মধ্যস্থতা করুন’

এবিএনএ : মিয়ানমারের রাখাইনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতন থেকে রেহাই পেতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে মুসলিম রোহিঙ্গারা। রাতের আঁধারে বিভিন্ন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দলে দলে তারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছেন।

বিজিবির কড়া নজরদারির মাঝেও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানো যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে প্রায় ৬ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

শুক্রবার সকাল থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে বিভিন্ন চিংড়ি প্রজেক্টের পাড়ে অবস্থান নেন। বিজিবি সদস্যরা ওইসব রোহিঙ্গাদের ঘিরে রেখেছেন। রোহিঙ্গাদের কোনোভাবেই বাংলাদেশর ভেতরে ডুকতে না দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিজিবি। রাতে কোনভাবে সীমান্ত পার হতে পারলেও পরবর্তীতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে কঠোর হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবির পক্ষ থেকে।

একটি ভিডিওটিতে দেখা যায় এক দল রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার জন্য বলছে বিজিবির কিছু সদস্য। দলটিতে অধিকাংশ নারী ও শিশুদের দেখা যায়। ক্রন্দনরত কয়েকজন নারীর মধ্যে একজন বলেন, আমরা যদি দেশে ফেরত যায়, সেখানের আর্মিরা আমাদের মেরে ফেলবে। তার চেয়ে বরং আমাদের আপনারা মেরে ফেলুন নয়তো ওদের সাথে মধ্যস্থতা করুন। আমরা সেখানে ফেরত যেতে চাই না।

এদিকে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে পড়েছেন, বিজিবি তাদেরকে রাতের মধ্যেই মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কথা জানিয়েছে। এ ছাড়াও অসংখ্য রোহিঙ্গা নর নারী নো ম্যানস ল্যান্ডে আটকে পড়ে আছেন। সীমান্তে প্রবেশ করাদের মধ্যে স্থানীয়রা খাবার-পানি বিতরণ করলেও নো ম্যানস ল্যান্ডে পৌঁছাতে পারছে না এপারের কেউ। যার কারণে সেখানে আটকে পড়া রোহিঙ্গারা খাদ্য ও পানির সংকটে পড়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, সোমবার বেলা ১১টার দিকে জলপাইতলী সীমান্ত এলাকায় তিন দিন ধরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদস্যদের কর্ডনে থাকা সহস্রাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে তাদের দেশের সীমানার কাছাকাছি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। শরণার্থী নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা সীমান্তের জিরো পয়েন্টে তাঁবু খাটিয়ে অবস্থান নেওয়া শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই মিয়ানমারের বিজিপি সদস্যরা কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়েন। এ সময় শরণার্থীরা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করে ফের বাংলাদেশ সীমান্তে আশ্রয় নেন। এ সময় মিয়ানমারের পাহাড়ের দু-তিনটি স্থানে আগুনের কুণ্ডলী ও ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়। এর আধঘণ্টা পর নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রু সীমান্তের জিরো পয়েন্টে পলিথিনের তাঁবু খাটিয়ে তিন দিন ধরে বিজিবির কর্ডনে থাকা প্রায় তিন হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর সবকটি তাঁবু জ্বালিয়ে দেয় মিয়ানমারের বিজিপি। এ ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই জিরো পয়েন্টের শরণার্থীরা কান্নাকাটি করে পালিয়ে দুই দেশের মাঝখানে থাকা একটি খাল পেরিয়ে তমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে আশ্রয় নেন।

এর আগে বিজিপি গুলি ছুড়লে তিনটি গুলি তমব্রু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দেয়ালে এসে লাগে। এ ঘটনার পরপরই স্কুলটি ছুটি ঘোষণা করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। গতকাল সকাল ৮টার দিকে জলপাইতলীর অস্থায়ী আশ্রয় ক্যাম্প থেকে মিয়ানমারের নিজ বাড়িতে যাওয়ার পথে জাবের আহমেদ (৪০) নামের একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয় বলে তার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন। বিজিবি ঘুনধুম ২৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মনজুর হাসান খান বলেন, ‘আমরা কাউকে পুশব্যাক করিনি এবং যেতে বাধ্যও করিনি। তারা তাদের দেশের সীমান্তে যেতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। এখানে আমাদের করণীয় কিছু নেই। ’

রবিবার রাত ও গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আনুমানিক ১০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন বলে স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের একাধিক সূত্রে জানা গেছে। মূলত নির্যাতনের মুখে প্রাণ বাঁচাতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ঢেকুবনিয়া, বাজারপাড়া, কিয়াত্তপাড়া, উত্তরপাড়া, ফকিরাপাড়া ও গাইট্টা বুইন্ন্যা এলাকা থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ সীমান্তের জিরো পয়েন্টে অস্থায়ী ঘর তৈরি এবং খোলা আকাশের নিচে জড় হয়েছেন। শুক্রবার থেকে তারা বাংলাদেশে ঢুকতে না পেরে জিরো পয়েন্টে অবস্থান করছেন।

সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে হঠাৎ করেই নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুনধুম সীমান্তে জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি মিয়ানমার আর্মির ৪০-৫০ জন সদস্য মহড়া দেন। এ সময় জিরো পয়েন্টে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিজিবি জিরো পয়েন্টে অবস্থানরত সবাইকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। মিয়ানমারের ঢেকুবনিয়াসহ বিভিন্ন এলাকার রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোয় এখনো হামলা ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছেন অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা।

তুমব্রু এলাকার আমবাগানে আশ্রয় নেওয়া রহিমা বিবি, হাজেরা খাতুন, আবদুল্লাহ জানান, ‘মিয়ানমারের আর্মি ও রাখাইন (মগ) যুবকরা একযোগে আমাদের পাড়ায় হামলা চালাচ্ছে। তারা তল্লাশি চালিয়ে নারীদের ধর্ষণ করছে এবং পুরুষদের হত্যা করছে। আমাদের বাড়িঘর সব পুড়িয়ে দিয়েছে। আমরা প্রাণভয়ে এখানে পালিয়ে এসেছি। ’ একই সময়ে মিয়ানমারের ভিতরে ব্যাপক গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে।

বান্দরবানের জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক বলেন, ‘সীমান্ত দিয়ে যাতে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেজন্য জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসনকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ’ কক্সবাজার বিজিবির ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মঞ্জুর হাসান খান বলেন, ‘দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া পুরো পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। আরও ১৫ হাজার বিজিবি সদস্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ’

টেকনাফে ১৪১ রোহিঙ্গাকে ফেরত : টেকনাফে সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশকালে ১৪১ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে বিজিবি ও পুলিশ। রবিবার ভোর থেকে গতকাল ভোররাত পর্যন্ত হোয়াইক্যং ও উনছিপ্রাং সীমান্ত এলাকা থেকে এসব রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। পরে স্ব স্ব সীমান্ত দিয়ে তাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো হয় বলে নিশ্চিত করেন ২ বিজিবির টেকনাফ ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম।

টেকনাফ হোয়াইক্যং পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মাহির উদ্দিন খান বলেন, ‘রবিবার রাতের বিভিন্ন সময়ে ফাঁড়ির সামনে চেকপোস্ট বসিয়ে সাতজন রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ। এর মধ্যে ছয়জন মিয়ানমারের মংডুর কুয়ারখালীর এবং একজন নাছিডং এলাকার। আটক রোহিঙ্গাদের বিজিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়। ’

আহত নয়জন চমেকে ভর্তি : মিয়ানমারে সেনা অভিযানে আহত নয়জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়ছে। এর মধ্যে সাতজন গুলিবিদ্ধ ও দুজন অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন। গুলিবিদ্ধরা হলেন মামুনুর রশিদ, শাকের, সাদেক, জাহেদ, নুরুল আলম, আবুল কাসেম ও নুরুল আমিন।

চমেক হাসপাতালের পুলিশ কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা যায়, মিয়ানমারে সেনা অভিযানে আহতদের প্রথমে কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য চমেকে নিয়ে আসা হয়। আগুনে ঝলসে যাওয়া দুজনকে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে।

Share this content:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button