ফিচার

মূল্যবোধের অবক্ষয় ও সামাজিক বিপর্যয়

এবিএনএ : মূল্যবোধের ভিত্তি হলো ধর্ম ও দর্শন। দীর্ঘ দিনের লালিত আচরণ-বিশ্বাস, সমাজের নিজস্ব আদর্শ ও নিয়ম-নীতি। সমাজে দীর্ঘদিনের রীতি-নীতি ও প্রথা মেনে চলা।সব ধরণের অর্জিত মানবীয় গুলাবলি সম্পর্কে সমাজের মানুষের যে ধারণা সেগুলোই হলো মূল্যবোধ।

নৈতিক মূল্যবোধ মানুষের জীবনে অনুসরণযোগ্য এমন কিছু আচরণবিধি, যা মানুষের জীবনব্যবস্থাকে করে  তোলে সুন্দর, নির্মল। এর সঙ্গে জড়িত সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, সর্বোপরি সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত হওয়া বিশেষ কতকগুলো গুণ। নৈতিকমূল্যবোধ মানবচরিত্রকে করে তোলে মহান। তাই মানুষের আত্মিক সামাজিক উৎকর্ষের জন্যে এবং জাতীয় জীবনে উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করার জন্যে সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের লালন, চর্চা ও বিকাশের বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

জাতীয় ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের ক্ষেত্রে এক সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ের কবলে পড়েছে বাংলাদেশ। দেশীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের ধারক-বাহক উচ্চবিত্ত এমনকি কিছু মধ্যবিত্ত শ্রেণি তাদের চিরায়ত মূল্যবোধ ও সামাজিক রীতিনীতির অবস্থান থেকে সরে এসে ভিন দেশি সংস্কৃতির প্রবাহে গা ভাসাচ্ছে। বিত্তশালীদের এসবভূমিকায় বিপর্যয়ের পথে দেশের আবহমান সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে ভয়াবহ হুমকির মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার স্থান দখল করছে বিকৃত মনোভাব সম্পন্ন একশ্রেণীর অতিবিত্তবান,উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের জ্ঞাণপাপী মানুষেরা।আধুনিকতার দোহাই দিয়ে বেলেল্লাপনার শেষ সীমা অতিক্রম করে চলেছে প্রতিনিয়ত।

পারিবারিক বন্ধনে শৈথিল্য, সন্তানদের প্রতি মা-বাবার উদাসীনতা, ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি অশ্রদ্ধা, বহিঃসংস্কৃতির সর্বগ্রাসী আক্রমণ, প্রকৃত শিক্ষা অর্জনে মনোনিবেশ না করে ছাত্র অবস্থায় অর্থের পেছনে বেপরোয়া ছুটে চলা যুবসমাজকে বিকৃতির সুযোগ করে দেওয়ায় বাংলাদেশ আজ এক নাজুক অবস্থায়পৌঁছেছে।

সমাজ-সভ্যতার বাহক ও রক্ষক উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণির আদর্শ বিচ্যুতি ও নির্লিপ্ততায় ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিবিরোধী অপশক্তিগুলোর প্রভাব-প্রতিপত্তির আওতা বিস্তৃত হচ্ছে। বিদেশি কিছু সিরিয়ালের প্রভাবে তরুন সমাজে যে সমস্ত নেতিবাচক দিক যেমন,নগ্নতা,ভায়োলেন্স,ইভ টিজিং,ইত্যাদিসামাজিক অবক্ষয়কে দিন দিন মহামারি আকারে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

বর্তমানে আমাদের সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের এই সর্বগ্রাসী অবক্ষয় চলছে তা রোধকল্পে কর্মসূচী গ্রহন করা এখন সময়ের দাবী । নতুবা সমাজ-রাষ্ট্রের নিশ্চিত অধঃপতন ঠেকানো যাবে না। এজন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের পাঠ্যসূচীতে  ছাত্র/ছাত্রীদের নৈতিক মূল্যবোধ সম্পর্কিত বিষয়গুলো অন্তর্ভূক্তকরতে হবে । ছাত্র/ছাত্রীদের এক্সট্রা একাডেমিক কর্মসূচীতে সম্পৃক্ত করে শারীরিক ও মানুষিক বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে । তরুণ সমাজকে বিভিন্ন সমাজসেবা মূলক কর্মসূচীতে অন্তর্ভূক্ত ও উৎসাহ দানে পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে ।

পাশ্চাত্যকে অনুসরণ না করে বাঙালির দেশিও ঐতিহ্যে শালীন পোশাক-আশাকে সন্তানদের অভ্যস্ত করা, মিডিয়াকে কেবল বাণিজ্যের দিকে নজর না দিয়ে দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি নজর রেখে কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

পারিবারিক, সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয়ভাবে সচেতনতামূলক কর্মকান্ড করতে না পারলে এ অকল্যাণকর অবস্থা থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। পারিবারিক ভাঙন তথা যৌথ পরিবার প্রথা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বলেও এমন ঘটনা ঘটতে পারে। যৌথ পরিবার প্রথা অটুট রাখতে সমাজ বা রাষ্ট্রের করণীয় নিয়েওচিন্তা করা যেতে পারে।

এই  অবক্ষয়কে থামাতে হলে প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের চর্চা। যে ব্যক্তির মধ্যে নৈতিক শিক্ষা থাকে, মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা থাকে সে কখনও অপরাধ করতে পারেনা। বরং সে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। আর যে ব্যক্তির নৈতিক শিক্ষা নেই, যে মূল্যবোধের মর্ম বোঝে না, সে সমাজবিরোধী অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। তাই অবক্ষয়কে রুখতে নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ চর্চা দুটোই অপরিহার্য। ভিনদেশি সংস্কৃতি বর্জন করতে না পারলে আমাদের হাজার বছর থেকে চলে আসা দীর্ঘ দিনের লালিত কৃষ্টিকালচার সংস্কৃতির অচিরেই হারিয়ে যাবে।

একটি জাতির নীতি-নৈতিকতা,ধর্ম ও দর্শন ও মূল্যবোধ সমৃদ্ধ থাকে সেই জাতির সামাজিক-সাংস্কৃতিক গতি-প্রকৃতি দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির অবস্থানকে উচ্ছে তুলে ধরে। যে জাতি যতো বেশি নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং নিজস্ব মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সে জাতি ততো বেশি সুসংহত ও উন্নত।নৈতিকতা ও মূল্যবোধ মানুষকে ন্যায় ও কল্যাণের পথে পরিচালিত করে।

সহনশীলতার অভাব, ধর্মের গুরুত্ব হ্রাস, নৈতিকতার অভাব, সামাজিক ভারসাম্যহীনতা, নগরায়ণ ও শিল্পায়ন, দারিদ্রতা, বেকারত্ব, দুর্নীতি, অশ্লীলতা, বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব, পেশীশক্তির প্রভাব, সুশাসনের অভাব ও মাদকের আগ্রাসনসহ বিভিন্ন কারণেমূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে বলে সমাজ বিজ্ঞানীরা মনে করেন।

Share this content:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button