এবিএনএ: রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেছেন, দুর্নীতি উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়, দেশ ও সমাজ থেকে যে-কোনো মূল্যে দুর্নীতি দূর করতে হবে। একজন দুর্নীতিবাজের পরিচয় শুধুই একজন দুর্নীতিবাজ। দুর্নীতিবাজ যে দলেরই হোক, দুর্নীতি করলে তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। আগামী দিনগুলোতে দুদককে দুর্নীতি দমনে আরো দৃঢ়তার সাথে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
আমি আশা করব, দুদক নিজেদের ঘর থেকেই এ অভিযান শুরু করবে। কিছুসংখ্যক লোকের জন্য যাতে পুরো দুর্নীতি দমন কমিশনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন। একইসাথে দুর্নীতির মাধ্যমে কোনো অনৈতিক সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে প্রলুব্ধ না করার জন্যও সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
আমি আশা করি, সংবিধানের আলোকে জনগণের মৌলিক মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রেখে নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সাথে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করে উত্তম চর্চার আলোকে আপনারা সেবা প্রদান অব্যাহত রাখবেন। দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। সৎ, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবানদের সামাজিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। তাহলেই দুর্নীতি হ্রাস পাবে।
বৃহস্পতিবার (০৯ ডিসেম্বর) আন্তর্জাতিক দুর্নীতি প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে দুর্নীতি দমন কমিশন আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে এসব কথা বলেন তিনি। আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় শিল্পকলা একাডেমীর নাট্যকলা অডিটোরিয়ামে। দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ’র সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের দুই কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক খান ও জহুরুল হক। এ সময় দুদকের মহাপরিচালক ও পরিচালকসহ বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, জাতিসংঘের প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রে আজ আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস পালিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যের যোগসূত্র হচ্ছে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস। দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের উচ্চকিত কণ্ঠ বিশ্বব্যাপী উচ্চারিত হচ্ছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘আপনার অধিকার, আপনার দায়িত্ব: দুর্নীতিকে না বলুন’ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও অর্থবহ হয়েছে বলে আমি মনে করি। জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত দুর্নীতিবিরোধী সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ দুর্নীতি দমনে অঙ্গীকারবদ্ধ।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘদিনের স্বাধীনতা-সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য ছিল মানবিক, বৈষম্যহীন, দারিদ্র্যমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক, দুর্নীতিমুক্ত শুদ্ধাচারী রাষ্ট্র ও সমাজ বিনির্মাণ করা। আমাদের পবিত্র সংবিধানে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমনে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। দুর্নীতি দমন, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ তথা সমাজে সততা ও নিষ্ঠাবোধ বিকাশের লক্ষ্যে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু জীবদ্দশায় কখনো দুর্নীতির সঙ্গে আপস করেননি। তিনি তার ভাষণে বার বার দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। ২৬ মার্চ ১৯৭৩ বঙ্গবন্ধু জয়পুরহাটে এক সমাবেশে বলেছিলেন, সৎভাবে কাজ করতে হবে। গরিবের অর্থ কেউ যেন আত্মসাৎ করে না খায়, গরিবের সম্পদ যেন আত্মসাৎ করে না খায়। দুর্নীতি বাংলার মাটি থেকে মুছে দিতে হবে।
মানুষের চাহিদার সীমা থাকে, কিন্তু লোভ সীমাহীন। দুর্নীতি এমন একটি বিষয় যা অতি প্রাচীনকাল থেকেই সমাজে প্রচলিত আছে। পৃথিবীর কোনো দেশই এর কুপ্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নয়। সামাজিকভাবে দুর্নীতিবিরোধী মনোভাব জাগ্রত না হলে কেবল দুর্নীতি দমন কমিশনের একার পক্ষে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব নয়।
মানুষের মাঝে দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতা তৈরি এবং দুর্নীতগ্রস্ত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের মাধ্যমেই কেবল দুর্নীতিকে সহনশীল মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিকল্প নেই। কোনো মানুষ দুর্নীতিবাজ হিসেবে জন্মগ্রহণ করে না। পারিবারিক, সামাজিক ও আশপাশের পরিবেশই মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। তাই দুর্নীতিবিরোধী অভিযান নিজের ঘর থেকেই শুরু করতে হবে। দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। সৎ, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবানদের সামাজিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। তাহলেই দুর্নীতি হ্রাস পাবে।
দুর্নীতি দমন কমিশন দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধ কার্যক্রম যুগপৎ পরিচালনা করছে। কমিশন কর্তৃক মামলা দায়ের যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি মামলায় সাজার হারও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক চালুকৃত জাতীয় হটলাইন সেবা ১০৬ ইতোমধ্যে জনগণের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর মাধ্যমে জনগণ যেকোনো দুর্নীতির ব্যাপারে অভিযোগ করতে পারছে। পাশাপাশি দুদক সচেতনতামূলক যেসব কার্যক্রম পরিচালনা করছে তা দীর্ঘমেয়াদে ফলপ্রসূ হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘সততা স্টোর’ ও ‘সততা সংঘের’ কার্যক্রম একটি অভিনব উদ্যোগ। আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা এর মাধ্যমে অধিকতর নীতিবান হয়ে গড়ে উঠবে। তাছাড়া মহানগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সচেতন নাগরিকদের সমন্বয়ে গঠিত দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটিও সমাজে দুর্নীতিবিরোধী মনোভাব তৈরি করবে এবং দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করতে দুদকের জন্য সহায়ক হবে বলে আমি মনে করি।
দুদক কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন কার্যক্রমে তারা যেন সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতা ও নৈতিকতা প্রদর্শন করেন। অন্যের দুর্নীতি চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার পূর্বে নিজেদের অনিয়ম ও অসততা দূর করতে হবে। যারা রাষ্ট্র কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব ও ক্ষমতার অপব্যবহার করবে তাদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে প্রচলিত আইনের মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনতে হবে। দুর্নীতি করলে শাস্তি পেতে হবে এবং দুর্নীতি করে কেউ পার পাবে না জনমনে এমন ধারণা জন্মাতে পারলেই দুদকের উপর জনগণের আস্থা বাড়বে।
দেশ-বিদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধী সংস্থা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে আমাদের কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে তাদেরকে দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলা অনুসন্ধান ও তদন্তে আরও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের সাথে সাথে দুর্নীতিবাজদের কৌশলও বদলেছে। তাই তাদের আইনের আওতায় আনতে হলে দুদককেও আরো কৌশলি হতে হবে, প্রশিক্ষিত জনবল ও প্রযুক্তিনির্ভর হতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।
প্রবাদে আছে, এই দুনিয়ায় হায়, সেই বেশি চায়, আছে যার ভুরি ভুরি। রাজার হস্ত করে কাঙ্গালের ধন চুরি। মানুষের চাওয়া পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ক্রমশ বাড়তে থাকে। চাওয়া-পাওয়ার সাথে সামর্থ্যের সামঞ্জস্য না থাকলেই দুর্নীতির বিস্তার ঘটে। তাই আয়ের সাথে ব্যয়ের সংগতি রেখে জীবন ধারণে অভ্যস্ত হলেই সমাজ থেকে দুর্নীতি হ্রাস পাবে। আমার বিশ্বাস, আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী দিবস উদযাপনের মধ্যদিয়ে নব উদ্যোগ ও কর্মপরিকল্পনা নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন দৃঢ় পদক্ষেপে সামনে এগিয়ে যাবে।