এ বি এন এ : বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে জেগে ওঠা নতুন ভূখণ্ডের মতো বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজারসি অঙ্গরাজ্যের আটলানটিক মহাসাগর বিধৌত আটলান্টিক সিটির বুকে গত তেইশ অাগস্ট , মঙ্গলবার যেন জেগে উঠেছিল একখণ্ড বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব অ্যাটলান্টিক কাউনটির উদ্যোগে সেন্ড ক্যাসল স্টেডিয়াম এর সুবিশাল প্রান্তরে অনুষ্ঠিত হলো “বাংলাদেশ মেলা ২০১৬” । বিকেল গড়াতেই নিউজারসির বিভিন্ন শহরে বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশীদের সব পথ এসে যেন মিশেছিল সেন্ড ক্যাসল ষ্টেডিয়াম এর খোলা প্রান্তরে।
পার্শ্ববর্তী অন্যান্য রাজ্য থেকেও প্রবাসী বাংলাদেশীদের সরব উপস্থিতি ছিল। সময় গড়াতেই প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাদা থিক থিক ভিড়ে এই মেলা পরিনত হয় জনারণ্যে। মেলার হরেক আয়োজনের মধ্যে ছিল দেশীয় পন্যের বিকিকিনি, দেশীয় খাবারের স্টল,কৃতী ছাএ-ছাএী সম্বর্ধনা, রেফেল ড্র,সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
“বাংলাদেশ মেলা”য় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল শামীম আহসান, আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন আটলান্টিক সিটির মেয়র ডন গার্ডিয়ান, অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন অ্যাসেম্বলিম্যান ক্রিস ব্রাউন, আটলান্টিক কাউনটি শেরিফ ফ্রাঙ্ক বেলিস, ব্রিগেনটিন সিটির মেয়র ফিলিপ গুয়েনথার,ক্রিস ফিলিসিও, আটলান্টিক সিটির কাউন্সিলরবৃন্দ ।
আয়োজক সংগঠনের সাধারন সম্পাদক শহীদ খান তাঁদেরকে উপস্থিত প্রবাসীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।বিকেল থেকেই প্রবাসী বাংলাদেশীরা মেলায় সমবেত হতে থাকে।বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে ওঠা শিশু- কিশোরদের অংশগ্রহন ছিল উল্লেখযোগ্য, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হাতে, কপালে জাতীয় পতাকার ব্যান্ড বেঁধে, জাতীয় পতাকার রংয়ের পোশাক পরে তারা মেলায় যোগ দেয়।তাদের উৎসাহ, উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। সারাক্ষণ নেচে-গেয়ে তারা মেলা প্রান্তরকে মুখরিত করে রাখে।
বিপুল সংখ্যক প্রবাসীর উপস্থিতিতে বিকেল সােয়া সাতটায় বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত পরিবেশনের পর প্রধান অতিথি জনাব শামীম আহসান বেলুন উড়িয়ে ‘বাংলাদেশ মেলা’র শুভ উদ্বোধন করেন।
এসময় বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব আটলান্টিক কাউনটির ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সাব্বির হোসেন ভূঁইয়া, আয়োজক সংগঠনের সভাপতি সেলিম সুলতান, সাধারন সম্পাদক শহীদ খান,সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুর রব, বাংলাদেশ মেলা- ২০১৬ আয়োজক কমিটির প্রধান উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর হোসেন ভূঁইয়া, আহবায়ক সৈয়দ মোঃ কাউছার,সদস্য সচিব মিরাজ খান,প্রধান তত্তাবধায়ক গোলাম হাফিজ, প্রধান পৃষ্ঠপোষক সাঈদ আলম মুকুল, প্রধান সমন্বয়কারী বিপ্লব দাশ, সার্বিক সহযোগীতায় প্রধান মোঃ সেলিম সহ বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব আটলান্টিক কাউনটির অন্যান্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ মেলায় বিভিন্ন পর্যায়ে বক্তব্য রাখেন প্রধান অতিথি সহ অন্যান্য অতিথিবৃন্দ। মেলার শুভ উদ্বোধন শেষে প্রবাসে বেড়ে ওঠা শিশু,কিশোর-কিশোরীদের পরিবেশনায় পরিবেশিত হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সংগীত শিল্পী সান্ত্বনা রায় চৌধুরীর পরিচালনায় ও কোরিওগ্রাফার নিবেদিতা ভট্টাচার্যের নির্দেশনায় ছোটদের নান্দনিক পরিবেশনা মেলায় উপস্থিত প্রবাসীদের বিমোহিত করে। এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করে সুদীপ্তা, অনামিকা , হৃদিকা, চন্দ্রিমা, শ্যাম, বর্ষণ, সারদা, অংকিতা ,পঞ্চতপা , বহ্নিশিখা, রিশা , পূর্ণতা, অর্চি,ঐন্দ্রিলা, অহনা, সপ্তর্ষি, ঐশিকা, কর্নেলিয়া, মনোশ্বেতা মনোলোভা, শ্রেষ্ঠাস্বরী প্রমুখ। তাদের মনোমুগ্ধকর সংগীত ও নৃত্য পরিবেশনা দেখে উপস্থিত প্রবাসীদের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়,তাদের ভ্রম হয় এই শিশু-কিশোররা কী প্রবাসে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম?এই র্পবটি সঞ্চালণা করেন জয়ন্ত সিনহা।
ছোটদের অনুষ্ঠানের পর স্থানীয় শিল্পী সান্ত্বনা রায় চৌধুরী সংগীত পরিবেশন করেন। বাংলাদেশ মেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল প্রবাসী বাংলাদেশী কৃতি ছাএ-ছাএীদেরকে সংবর্ধনা। এই মেলায় বিভিন্ন গ্রেডের কৃতী ছাএ-ছাএীদেরকে ক্রেস্ট ও সনদপএ প্রদান করে সংবর্ধিত করা হয়।কৃতী ছাএ-ছাএীদের মাঝে ক্রেস্ট বিতরন করেন মেলায় আগত অতিথিবৃন্দ। এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কৃতী ছাএ-ছাএীদের পক্ষে বক্তব্য রাখে কৃতী ছাএী পঞ্চতপা বল ও কৃতী ছাএ অদ্রি চৌধুরি। বিপ্লব দেবের সঞ্চালণায় আয়োজক সংগঠনের এই কৃতী ছাএ-ছাএী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি মেলায় উপস্থিত প্রবাসী বাংলাদেশীদের বেশ প্রশংসা কুড়োয়। বাংলাদেশ মেলার বিভিন্ন ষ্টলে দেশীয় পণ্য ও খাবারের স্টলগুলোতে বিকিকিনি ছিল লক্ষ্যণীয় । বাংলাদেশ মেলার অনুষ্ঠান সঞ্চালণা করেন সাদিয়া খন্দকার ,তাঁর সাবলীল উপস্থাপনা সবার প্রশংসা কুড়োয়।
বাংলাদেশ মেলায় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার অংশবিশেষ আবৃত্তি করেন বাচিক শিল্পী সুব্রত চৌধুরি, কোরিওগ্রাফার নিবেদিতা ভট্টাচার্যর নির্দেশনায় কবিতা আবৃত্তির সাথে নৃত্য পরিবেশন করে খুদে নৃত্য শিল্পী হৃদিকা ও অনামিকা। বাংলাদেশের জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত কিংবদন্তী সংগীত শিল্পী নীনা হামিদকে বাংলাদেশ মেলায় বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয়।তাঁর হাতে সম্মাননা স্মারক হিসাবে ক্রেস্ট তুলে দেন আয়োজক সংগঠনের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সাব্বির হোসেন ভূঁইয়া।প্রবাসীদের অনুরোধে তিনি একটি গান গেয়ে শোনান।
মেলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন সংগীত শিল্পী লতিফ সরকার, কৃষ্ণা তিথি ,রাজীব ভট্টাচার্য । তারা বিভিন্ন ধরনের সংগীত পরিবেশন করে দর্শকদের মাতিয়ে রাখেন। সবশেষে মঞ্চ মাতাতে আসেন বাংলার কোকিল কণ্ঠি হিসাবে খ্যাত ব্ল্যাক ডায়মণ্ড বেবী নাজনীন। শিল্পী মঞ্চে এসে দাঁড়াতেই প্রবাসীরা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন।দর্শকদের অভিবাদন গ্রহন শেষে শিল্পীর একের পর এর সুরের মূর্ছনায় প্রবাসীরা অনাবিল আনন্দে মেতে ওঠেন। তাঁর গানের সাথে নেচে-গেয়ে প্রবাসীরা বেশ আনন্দ উপভোগ করেন। যন্ত্র সংগীতে শিল্পীদেরকে সহযোগীতা করেন মাটি ব্যান্ড এর যন্ত্র শিল্পীরা।
বাংলাদেশ মেলার মূল স্পন্সর ছিল স্টার ক্যাবল ও ইভেন্ট সহযোগীতায় ছিল ইভেন্ট ইউএসএ এন্টারটেইনমেণ্ট। রেফেল ড্রর মাধ্যমে বাংলাদেশ মেলার সমাপ্তি ঘটে।এতে বেশ কিছু আকর্ষণীয় পুরস্কারের সমাহার ছিল। এমনিতেই বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব আটলান্টিক কাউনটির সব কর্মকাণ্ডেই নান্দনিকতার ছোঁয়া মেলে, বাংলাদেশ মেলার বিশাল মহাযজ্ঞ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের মাধ্যমে সংগঠকরা তাঁদের সাংগঠনিক দক্ষতার সর্বোচ্চ উৎকর্ষতার প্রমান দেন।যে কারনে তাঁরা উপস্থিত প্রবাসীদের বেশ বাহবা কুড়ান। বাংলাদেশ মেলার আহবায়ক সৈয়দ মোঃ কাউসার সমাপনী বক্তব্য রাখেন।
অনতিদূরে্ গির্জার গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকটা ঢং ঢং করে জানিয়ে দেয় রাত নিশুতির কথা।আইনগত বাধ্যবাধকতার কারনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মধ্যরাতের অনেক পরে বাংলাদেশ মেলার পর্দা নামে। এক সময় নিভে আসে মেলার আনন্দ আলো।প্রবাসীরা নিজ নিজ ডেরায় ফিরে যায় মুঠো মুঠো সুখস্মৃতি নিয়ে,আর সফল মেলা আয়োজনের জন্য আয়োজকদের টুপিখোলা অভিনন্দন জানিয়ে।