আন্তর্জাতিকলিড নিউজ
মিয়ানমারে নিষিদ্ধ সেই উগ্র বৌদ্ধ ভিক্ষু এবার বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে ফেসবুকে

এবিএনএ : রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানোর জন্য উগ্র বৌদ্ধজাতীয়তাবাদী ধর্ম প্রচারক আশিয়ান উইরাথুকে গত বছর জনসম্মুখে প্রচারণা চালানো নিষিদ্ধ করে মিয়ানমার সরকার। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নিপীড়নের জন্য সমালোচিত সরকার যেখানে তাকে নিষিদ্ধ করেছে, সেখানে ফেসবুকে ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
প্রতিদিন এই বৌদ্ধ ধর্মগুরু ফেসবুকে মিথ্যা তথ্য পোস্ট করার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের আগ্রাসী বিদেশি শক্তি হিসেবে মিয়ানমারের জনমানসে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া ডিভিশনের মুখপাত্র ফিল রবার্টসন বলেন, ফেসবুকে কেউ স্বস্তিকা (হিটলারের প্রতীক) পোস্ট করলেও সেটা সরিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু উইরাথু মুসলিমদের কুকুর বলে বক্তব্য দিলেও তার বিদ্বেষপ্রসূত পোস্টের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না।

মিয়ানমারে ফেসবুক এত বেশি প্রভাবশালী যে অনেকের কাছে ইন্টারনেট মানেই ফেসবুক। আর সেখানে এই বিদ্বেষপ্রসূত ভাষার ব্যবহার মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে বজায় থাকা জাতিগত বিদ্বেষ আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির মুখপাত্র জাও তাই তার ফেসবুক পেজে কিছু আগুন দেয়ার ছবি পোস্ট দিয়ে বলা হয়, রোহিঙ্গারা নিজেদের ঘরে আগুন দিচ্ছে। সেই ছবিগুলো ভুয়া প্রমাণিত হওয়ার পরে সেগুলো ফেসবুকে এখনো রয়ে গেছে।
গত আগস্টের ২৫ তারিখের পরে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উপর শুরু হওয়া সংঘাতে ৬ লাখ মানুষ পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। প্রায় ২০০ কোটি ব্যবহারকারীর ফেসবুকে প্রতিদিন কয়েকশো কোটি পোস্ট করে যা তাদের ‘কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড’ নামের নীতিমালা দিয়ে ‘স্ক্রিনিং’ করা হয়। কিছু কিছু হুমকি ‘ম্যানুয়ালি’ মোকাবেলা করা হয় এবং কখনো সরিয়ে ফেলা হয়। ২০১৬ মার্কিন নির্বাচনের সময়ে ফেসবুকে ভুয়া তথ্য ও সংবাদ ছড়ানোর কারণে কিছু গাইডলাইন প্রদান করে। তবে ফেসবুক ভুয়া তথ্য স্বপ্রণোদিত হয়ে সরায় না।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো জানিয়েছে, ফেসবুকের কর্মপদ্ধতির কারণে মিথ্যা তথ্য, খবর ও মতামত মিয়ানমার জনপরিসরে ছড়িয়ে পড়েছে এবং জনগণের মধ্যে সত্য ও প্রোপাগান্ডার পার্থক্য নির্ধারণের বোধকে দুর্বল করে ফেলছে। ২০১৪ সালের আগ পর্যন্ত সামরিক জান্তা নিয়ন্ত্রিত মিয়ানমারে মোবাইল সিম ব্যবহার করা প্রায় দুঃসাধ্য ছিল। কিন্তু গত তিন বছরে মোবাইল সিমের দাম কমে আসায় ব্যাপকভাবে এর ব্যবহার বেড়েছে, আর বেড়েছে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা। ২০১৪ সালে যেখানে মিয়ানমারে ফেসবুক ব্যবহারকারী ছিল ২০ লাখ, বিগত ৩ বছরে সেটা বেড়ে হয়েছে ৩ কোটি।

আর এই তিন কোটি ব্যবহারকারীর মধ্যে উইরাথুসহ অন্যদের বিদ্বেষপ্রসূত বক্তব্য ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। এবং ফেসবুক ডিজাইনের কারণে যেসব বক্তব্য বেশি শেয়ার ও লাইক করা হচ্ছে সেগুলো নিউজফিডে বেশি সময় ধরে থাকছে। আশিন উইরাথুর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট লাখো মানুষ অনুসরণ করে, তার পোস্টে বিকৃত ও গলিত লাশের ছবি, ভিডিও থাকে যেগুলোকে তিনি রোহিঙ্গাদের আক্রমণে নিহত বৌদ্ধ হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি তার পোস্টে রোহিঙ্গাদের ‘বাঙ্গালি’ বলে অভিহিত করেন।
ফেসবুক তার কিছু পোস্ট সরিয়ে নেয় এবং কিছু সময়ের জন্য তার পেজ রেস্ট্রিক্টেড করে রাখা হয়। কিন্তু বর্তমানে আবার তার পেজ সক্রিয় রয়েছে। সম্প্রতি এক সাক্ষাতকারে উইরাথু বলেন, যদি ফেসবুক তার পেজ সরিয়ে ফেলে তাহলে তিনি নতুন আরেকটি পেজ খুলবেন। যদি কারো আমার পোস্ট ভালো না লাগে তাহলে তারা আমার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন।
শুধু উইরাথুই নন, মিয়ানমারের সরকার ও সামরিক বাহিনীর ভেরিফাইড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকেও ভুয়া তথ্য প্রচারিত হয়। রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়নের নেতৃত্বদানকারী মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের ফেসবুক পেজে ১৩ লাখ ফলোয়ার রয়েছে। গত ১৫ সেপ্টেম্বরের এক পোস্টে বলা হয়, নতুন ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘উগ্র বাঙ্গালিরা’ যেন রাখাইনে শক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলতে না পারে।

রোহিঙ্গা অধিকারকর্মীরাও নিপীড়নের প্রমাণ হিসেবে ভয়াবহ ছবি ও ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করেছে। কখনো কখনো এসব ছবি ফেসবুক সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ফেসবুকের মুখপাত্র ওয়ারেইং বলেন, যখন কেউ সহিংসতা উদযাপন করার জন্য ফেসবুকে শেয়ার করে তখন সেটা সরিয়ে নেয়া হয়। যখন কোনো ছবি সংবাদ হওয়ার যোগ্য অথবা জনগুরুত্বপুর্ণ বলে বিবেচিত হয়, তখন ফেসবুকের নীতিমালার বিরুদ্ধে গেলেও সেটা সরানো হয় না।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের অ্যানালিস্ট রিচার্ড ওয়েইর বলেন, পরিস্থিতি আসলেই জটিল। এখানে কেউ উসকানি দেয়ার জন্য আর কেউ তথ্য ছড়ানোর জন্য ছবি ও ভিডিও পোস্ট করছে। এটা বোঝা কঠিন যে কোনটা প্রকৃতপক্ষে কী উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে।
Share this content: