এবিএনএ : একজন মানুষের সুন্দর আচরণ অন্যকে সম্মানিত করার পাশাপাশি সম্মানিত করে নিজেকেও। একই সঙ্গে শিশুর সুন্দর আচরণ পারিবারিক অনুশাসন ও পারিবারিক শিক্ষার প্রতিফলনও বটে। আপনার সন্তানের সুন্দর আচরণ অন্যের কাছে আদতে আপনাকেও সম্মানিত করে। আচরণ বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুর সুন্দর আচরণ তার মাঝে মানবিকতা, আত্মবিশ্বাস, সামাজিকতাসহ আরো বেশ কিছু অসাধারণ গুণ গড়ে তোলে। তাই শিশু বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ভালো আচরণ শেখানোটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানের বাড়ন্ত বয়সে শেখানো উচিত এমন কিছু মৌলিক আচরণ নিয়েই এ প্রতিবেদন।
* দুষ্টুমি শিশুরা করবেই। কিন্তু আপনি তাকে শেখান তার দুষ্টুমি যেন কারোর ক্ষতির কারণ না হয়। কারো বাসায় বেড়াতে গেলে সেখানকার এটে-সেটা অনুমতি ছাড়াই নিয়ে নেওয়া কিংবা দুষ্টুমি করতে গিয়ে সেখানকার কোনো জিনিস নষ্ট করার মতো বিষয় যেন তার দ্বারা না ঘটে।
* শেয়ার করার অসাধারণ গুণটি মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক যেমন সুন্দর করে তেমনি মানসিক প্রশান্তিও বাড়ায়। সন্তানকে ছোট থেকেই শেয়ারিং শেখাতে পারেন। নিজের ভাই-বোন বা কাজিনদের সঙ্গে নিজের খেলনা শেয়ার করা, মাঝে মাঝে একজন দুস্থ মানুষকে সাহায্য করা কিংবা বাসায় এনে তার সঙ্গে খাবার শেয়ার করার মাধ্যমে ছোট থেকেই সন্তানের মাঝে এই অসাধারণ গুণটি গড়ে তুলুন।
* দুজন ব্যক্তির কথোপকথন চলাকালীন তাদের মাঝখানে ব্যাঘাত ঘটানো উচিত নয়, যদি না খুব প্রয়োজন হয়। এই ধরনের আচরণ মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করতে পারে। তাই আপনার সন্তানকে এই ধরনের আচরণ করতে নিষেধ করুন।
* কারো চারিত্রিক বা শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে মন্তব্য করাটা কেন উচিত নয় তা বোঝান, যদি তা প্রশংসামূলক না হয়। কোন বিষয়গুলো বুলিং-এর পর্যায়ে পড়ে তা সন্তানকে শেখান। কারো নাম ব্যঙ্গ করা, শারীরিক গড়নের জন্য কাউকে নিয়ে মজা করা, স্কুলে পড়ালেখায় দুর্বল ছাত্রটিকে নিয়ে মজা করা; এমন আরো যেসব বুলিং রয়েছে সেসব নিয়ে সন্তানের সঙ্গে কথা বলুন। এতে বুলিং-এর শিকার মানুষটি কতটা কষ্ট পায় তা সন্তানকে বুঝিয়ে বলুন।
* কিভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হয়, কৃতজ্ঞতা জানিয়ে নোট লিখতে হয় তা শেখান। বিশেষ করে সে যখন কারো কাছ থেকে কোনো উপহার গ্রহণ করে তখন প্রদানকারীকে ধন্যবাদ দেয়ার আগে তা খুলে দেখা বা ব্যবহার করা উচিত নয়।
* স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কেও আপনার সন্তানকে সচেতন করা উচিত। হাঁচি বা কাশির সময় মুখে রুমাল দিতে শেখান এবং অন্যের সামনে দাঁত ও নাক খোঁচানো থেকে বিরত থাকতে বলুন এবং সবসময় তাকে টিস্যু ব্যবহার করতে শেখান।
* কেউ যখন তাকে কেমন আছো প্রশ্ন করবে তখন বিনয়ের সঙ্গে জবাব দেওয়া শেখান এবং প্রশ্নটি তাকেও করতে বলুন।
* তাকে বলুন, অন্যের গোপনীয়তাকে সম্মান করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কারো রুমে প্রবেশের দরকার হলে দরজায় নক করা এবং অনুমতি পাওয়ার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলুন।
* আপনার সন্তানকে টেবিলে খাবার সময় ভদ্রতা সম্পর্কে সচেতন করুন। খাবারের প্লেট তার সামনে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে শেখান।
* অন্যের সুবিধার জন্য সবসময় দরজা খুলে তা ধরে রাখতে শেখান এবং কেউ যদি তার সুবিধার জন্য দরজা খুলে ধরে রাখে তবে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাতে বলুন।
* পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সে সম্পর্কে বলুন। খেলাধুলা এবং খাবার পর কিভাবে নিজেকে পরিষ্কার রাখতে হয় তা তাকে শেখান।
* পরিচিত কিংবা অপরিচিত কারো সঙ্গে কথা বলার সময় কিভাবে সম্বোধন করতে হয় সে সম্পর্কে আপনার সন্তানকে অবগত করুন।
* তাকে বলুন, কেন সবসময় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, হেরে যাওয়া বা জয়ী হওয়াটা বড় কথা নয়।
* আপনার সন্তানকে শেখান, সে অন্যের বাড়িতে প্রবেশের সময় অবশ্যই যেন জুতা খুলে প্রবেশ করে।
* আপনার সন্তানকে নিজের প্রতি যত্নশীল হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হতেও শেখান। তার দ্বারা যেন পরিবেশের কোনো ক্ষতি না হয় তা শেখান। চারপাশ অপরিষ্কার না করতে শেখান এবং পরিবেশের জন্য এটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা বলুন। শুরু করতে পারেন যেখান সেখানে ময়লা বা থুথু না ফেলার অভ্যাস তৈরি করার মাধ্যমে।
* নিজেদের ভুল তাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করুন। এতে বোঝা যায়, কেউ এই পৃথিবীতে নিখুঁত নয়। সবার ভুলভ্রান্তি হতে পারে। ‘আমি ভুল করতে পারি না’ এই অহংকার যেন নিজের ভুল হলে স্বীকার করতে আর এ জন্য ক্ষমা চাইতে নিবৃত্ত না করে।
* সন্তান কোনো ভুল করলে তাকে দুঃখিত/স্যরি বলা শেখান। অভিভাবক হিসেবে আপনি যদি কোনো প্রকার ভুল করে ফেলেন তবে সরি/দুঃখিত বলুন। আপনি স্যরি বলার অভ্যেস না করলে সেও বলবে না। সে ধরেই নেবে যে স্যরি বলা খুবই অপমানজনক কাজ।
কীভাবে আপনার সন্তানকে শিষ্টাচারগুলো শেখাবেন
* প্রথম পদক্ষেপটি হলো ভালো অভ্যাসগুলোকে আপনার নিজের মধ্যে আয়ত্ত করা। বাচ্চারা তাদের মা–বাবাকে তাদের রোল মডেল হিসেবে দেখে। আপনি যদি চান যে আপনার সন্তানের মধ্যে শিষ্টাচারগুলো গড়ে উঠুক, তবে আপনি তাকে যা শেখাতে চান তা তাদের সামনে নিজেও অনুশীলন করুন। এমনকি হতাশার মুহূর্তগুলোতেও বাচ্চাদের সামনে যেন আপনার শিষ্টাচার, ভালো আদব–কায়দা বজায় রাখা থেকে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়বেন না।
* নম্র ও বিনয়ী হয়ে ওঠা, দরজায় খটখট করা, কাজ হয়ে যাওয়ার পর ঘরদোর গুছিয়ে নিজেকে ফিটফাট ও পরিষ্কার রাখা, খাবার টেবিলের আদবকায়দা ইত্যাদির মতো সুঅভ্যাসগুলো বাসায় আপনার বাচ্চার সঙ্গে বারবার অনুশীলন করতে পারেন, যতক্ষণ না সেগুলো তাদের মনের মধ্যে এবং আচরণে পাকাপাকিভাবে স্থায়ী হয়ে যায়।
* আপনার সন্তান যখন সু–অভ্যাসগুলো কাজে লাগিয়ে দেখায়, তখন তার প্রশংসা করার বিষয়টি নিশ্চিত করুন এবং প্রতিবার ভালো কিছু করার সঙ্গে তাকে উৎসাহ প্রদান করলে তা তাকে আরও ভালো হয়ে উঠতে সাহায্য করবে। সন্তানের সু–অভ্যাস এবং ভালো আচার-আচরণগুলোকে উপেক্ষা করার বিপরীত প্রভাব হতে পারে, কারণ তারা আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য হয়তো খারাপ আচরণ করতে পারে।
* আপনার সন্তান যখন কিছু ভুল করে তখন তা তাকে সংশোধন করে দিন, এমনকি সেটা যদি অন্য কারও সঙ্গে কথোপথনের মাঝে হয়ে থাকে তখনও আপনার বাচ্চাকে কয়েক মুহূর্তের জন্য থামান এবং দ্রুত তার ভুলটিকে শুধরে দিন। তবে আপনার শিশুটি যদি অত্যন্ত আত্মমর্যাদা মনোভাবী হয়ে থাকে তাহলে পরে ব্যক্তিগতভাবে তাকে সেটা বলতে পারেন।
* বাচ্চাদের কম মনোযোগ এবং দুরন্তপনা আপনাকে হয়তো একাধিকবার বিরক্ত ও হতাশ করে তুলবে, কিন্তু ধৈর্যশীল হন। ধৈর্যচ্যুত না হওয়া এবং সন্তানের ওপর রেগে না যাওয়া উচিত। আপনি যদি শান্ত ও অনড় থাকেন, তবে আপনার সন্তানও সেই একইভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে।
তথ্যসূত্র: রিডার্স ডাইজেস্ট, ফার্স্ট ক্রাই