তারেক বিন হাম্জা : লাইলাতুল ক্বদর অর্থ ভাগ্য রজনী। লাইল শব্দের অর্থ রাত বা রজনী। ক্বদর শব্দের অর্থ ভাগ্য। আমাদের দেশে এটি শব-ই-ক্বদর হিসেবে পরিচিত। এটি ফারসী এবং আরবী শব্দ। শব ফারসী শব্দ এবং ক্বদর আরবী শব্দ। সুতরাং এদিক থেকে ও শব-ই-ক্বদর অর্থ ভাগ্য রজনী। পবিত্র কুরআনে ক্বদর বিষয়ে অনেক উদ্বৃতি আছে। আল্লাহ তা’আলা ক্বদর নামে একটি সুরা নাযিল করেছেন। সেখানে তিনি প্রথমে ক্বদরের রাতে কুরআন নাযিলের কথা ঘোষনা করেছেন। এরপর তিনি ক্বদরের রাতকে হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম ঘোসনা করেছেন। এবং সে রাতে যাবতীয় সিদ্ধান্ত এবং শাস্তি ও কল্যাণসহ জিবরাইল (আঃ) ও ফেরেশতা প্রেরনের কথা উল্লেখ করেছেন। পরিশেষে তিনি ক্বদরের রাতের সময়সীমাও নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
আরবী, বাংলা, ইংরেজী অভিধানে ভাগ্যের নানারকম অর্থ ও সংজ্ঞা দেয়া আছে। যেমন অদৃষ্ট নসিব কপাল নিয়তি পরিণতি দৈব ইত্যাদি।
ক্বদরের অর্থ ভাগ্য উন্নয়ন। এই অর্থে লাইলাতুল ক্বদর অর্থ ভাগ্যোন্নয়নের রাত। এ ভাগ্যোন্নয়নের অর্থ এ নয় যে এ রাত্রে যত বেশী নফল ইবাদত করা যাবে ততোই আল্লাহ এক বছরের জন্যে তারভাগ্যে এমন অনেক কিছু লিখে দিবেন যার দ্বারা তার ভাগ্যের পরিবর্তন হয়ে যাবে এবং সে ধনী মালদার এমন একটা কিছু হয়ে যাবে এবং এক বছরের মধ্যে তার কোন রোগ ব্যাধি হবে না। এইরূপ চিন্তা করা ইসলামী আক্বীদার খেলাপ। মুলকথা হচ্ছে এই যে কারো ব্যক্তি বিশেষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে বা ব্যক্তিগত জীবনের ভাগ্যের উন্নতি হবে; এটা নয়, ভাগ্যের উন্নতি হবে গোটা মানব জাতির। অর্থাৎ যে রাত্রে কুরআন নাযিল হয় ঐ রাতটা হচ্ছে কুরআন নাযিল পরবর্তী দুনিয়াবাসীদের জন্যে এক ভাগ্য উন্নয়নের রাত। এর মূল অর্থ হলো ভাগ্য উন্নয়নের জন্যে জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যার এবং চিকিৎসাও কারিগরী বিদ্যার যে প্রভৃত উন্নতি সাধন দরকার তার সবকিছুর উৎস রয়েছে যে কুরআনে সেই কুরআন নাযিল হওয়ার রাতটাই হচ্ছে লাইলাতুল ক্বদর। অর্থাৎ ভাগ্যোন্নয়নের জন্যে যা যা দরকার তার সবকিছুই অর্থাৎ তার জ্ঞানের সবকিছুর উৎসই নাযিল হলো এ রাত্রে। ঐ প্রসঙ্গে এ সুরার ঐ কথাটিার দিকে লক্ষ্য করে চিন্তা করতে পারি যে আল্লাহ কেন বললেন-
(ওমা- আদ্রকা মা-লাইলাতুল ক্বর্দ)
অর্থাৎ-”তুমি কি জান লাইলাতুল ক্বদর কী ?
কারণ এখনই তা জানবার কথা নয়, এ রাত্রে যে কুরআন নাযিল হওয়া শুরু হলো বা লওহে মাহ্ফুজ থেকে আল কুরআনকে পৃথিবীতে নাযিল করার স্থাানন্তর করা হলো, তা পুরোপুরি নাযিল হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তোমাদের তা জানবার কথা নয়। যখন সম্পূর্ন কুরআন নাযিল হয়ে যাবে এবং আল কুরআন থেকে বিজ্ঞানের এক একটা উৎস বের করে নতুন নতুন এমন জিনিস আবিষ্কার হবে যাতে পৃৃথিবীর ভাগ্যের উন্নয়ন হবে, তখন বুঝবে ক্বদরের আসল-ব্যাখ্যা।
সুরা ক্বদরে বলা হয়েছে-
(লাইলাতুল ক্বদরী খয়রুম মীন আলফি শাহ্র)
অর্থাৎ হাজার রাতের চাইতে উত্তম এ ক্বদরের রাত।
এর অর্থ এই নয় যে এই রাতে ইবাদত করলে ১ হাজার মাসের রাত অর্থাৎ ১০০০ ী ৩০ = ৩০০০০ দিন। কাজেই এক রাতের সওয়াব হবে ৩০ হাজার রাতের ইবাদতের সমান। এর মূল অর্থ হলো এ রাতে তোমাদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্যে আল কুরআনের মাধ্যমে তোমাদেরকে আল্লাহ যা দান করেছেন তা বিগত যুগের হাজার হাজার রাতেও মানব জাতিকে দেয়া হয় নি, অর্থাৎ কুরআন নাযিল হওয়ার রাতে তোমরা যা পেলে বিগত দিনের মধ্যে কত হাজার মাস গুজরে গেছে, যে মাসের মধ্যে এরূপ একটা রাত কখনো আসেনি যে রাতে কুরআন নাযিল হয়েছিল।এইটাই মূল ভাবার্থ। এরপর এ মূল ভাবার্থ এ রাত্রে যেমন কাজের হুকুম পেলে তা একবার মেনে দেখ তাহলে দেখতে পাবে আল-কুরআনের প্রত্যেকটি নির্দেশ মানার মধ্যেই রয়েছে শান্তি আর শান্তি। আর কুরআনী নির্দেশ থেকে তোমরা যতই সরে পড়বে ততই দেখবে অশান্তি আর অশান্তি। শান্তির লেশ মাত্রও পাবে না। কথাগুলো কাঁটায় কাঁটায় সত্য। এটা কি মানব জাতির ভাগ্যোন্নয়নের ব্যাপার নয় ?
রমযান মাসে ক্বদরের রাত্রির উপস্থিতি মানবজাতিকে ভাগ্য নিয়ে নতুন করে ভাবতে সাহায্য করে। তার ভবিষ্যত তার চুড়ান্ত পরিণতি সম্বন্ধে আগ্রহী করে তোলে। সব হতাশার দোলাচল অতিক্রম করে সৌভাগ্যবানদের কাতারে সামিল হওয়ার স্বপ্ন দেখায়।
ক্বদরের রাত হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম।
ক্বদরের রাত অত্যন্ত মুবারক ও বরকতময়।
ক্বদরের রাতই ভাগ্য রজনী।
ক্বদরের রাতে ফিরিশতা অবতীর্ণ হয়।
ক্বদরের রাত সালাম ও শান্তির রাত।
ক্বদরের রাত নামায আদায় ও গুনাহ মাফের রাত।
বিশেষ কোন মাস বা রাতকে ভাগ্য পরিবর্তনের উৎস মনে করা উচিৎ নয়। মহান আল্লাহ ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যে কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। কুরআন গ্রহণ ও ত্যাগের সঙ্গে ভাগ্যের সম্পর্ক। শক্তভাবে কুরআন ধরার মাধ্যমে সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভূক্ত হওয়া সম্ভব। কুরআন বাদ দিয়ে অন্য কোন উপায়ে কেউ কখনও ভাগ্যবানদের দলভূক্ত হতে পারে না।
লাইলাতুল ক্বদরে করণীয় ঃ
ভাগ্য সম্পর্কে বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনাকে সঠিক স্বচ্ছ ও সমৃদ্ধ করুন।
ভাগ্যের উপরে অন্ধভাবে নির্ভর করে কর্মহীনতার ধারণাকে প্রশ্রয় দিবেন না।
সৌভাগ্যবানদের উদাহরণ অনুসরণ করুন।
দুর্ভাগাদের পথ মতকে অগ্রাহ্য করুন।
ভাগ্য গণনার নানাবিধ প্রচলিত পন্থাকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করুন।
গোটা রমযানকে ভাগ্যোন্নয়নের উৎস বানিয়ে ফেলুন। কোনক্রমেই শুধু ২৭ রমযানকে ভাগ্যরজনী হিসেবে সীমাবদ্ধ করবেন না।
অন্তত ঃ রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে ক্বদর অনুসন্ধানের চেষ্টা করুন।
কেবলমাত্র আল্লাহ তা’আলাকেই ভাগ্য জানা ও নিয়ন্ত্রনের মালিক মনে করুন। আর অন্য কাউকে এ অধিকার দিবেন না।
অন্যায় ও অবৈধভাবে সম্পদ সুনাম ও ক্ষমতা লাভকারীদেরকে কখনও ভাগ্যবান মনে করবেন না।
সৎ ও ন্যায়পরায়ণদের বাহ্যিকভাবে দুর্বল দরিদ্র ও অক্ষম দেখে হতভাগা মনে করবেন না।
আল কুরআন পরিপূর্ণ অনুসরনে সৌভাগ্য জড়িত এই ধারণা শাণিত করুন।
লাইলাতুল ক্বদরে নিন্মোক্ত দু’আটি করা সুন্নাত
”আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন কারীমুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নী”
হে আল্লাহ ! আপনি বড়ই ক্ষমাশীল, বড়ই দয়ালু, ক্ষমা করতে আপনি ভালোবাসেন; অতএব, আমার গুনাহ সমূহ মাফ করে দিন।(আহমদ, তিরমিযি, ইবন মাজাহ)
হে আল্লাহ আমাদেরকে লাইলাতুল ক্বদর রাতের মহত্ত্ব বুঝার তৌফিক দান করুন । আমিন ॥