
এবিএনএ : ‘আমার বাবা মারা যাওয়ার পর যেমন কষ্ট হয়েছিল, আজ নেতা মারা যাওয়ার খবর পেয়ে একই কষ্ট হচ্ছে। সেনবাবু আমার রাজনৈতিক গুরু, আমার বাবার মতো ছিলেন। সারা রাত ঘুমাই নাই। ভোর হওয়ার আগেই নেতার বাসায় চইলা আইছি।’ চোখের জল মুছতে মুছতে বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর স্মৃতিচারণা করে কথাগুলো বলছিলেন আবদুল মুকিত সরদার।
৬২ বছর বয়সী আবদুল মুকিতের বাড়ি দিরাই উপজেলার জগদল ইউনিয়নের বকশীপুর গ্রামে। আজ রোববার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে দিরাই পৌর শহরের থানা রোডে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর বাড়ির আঙিনায় তাঁর সঙ্গে কথা হয়।
অসংখ্য মানুষ সকাল থেকে এসে ভিড় করেছে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর বাড়িতে। পৌর শহরের থানা রোডে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর দোতলা বাড়িটি বাংলো টাইপের। ঘরের সামনে জাতীয় পতাকার পাশে কালো পতাকা উড়ছে। নিচতলায় উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সব অঙ্গসংগঠনের কার্যালয়। এখানে নেতা-কর্মীদের ভিড়। দোতলায় দুটি কক্ষ। দিরাইয়ে এলে তারই একটি কক্ষে থাকতেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। এই বাড়ির দরজা সব সময় খোলা থাকত নেতা-কর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষের জন্য।
নিচতলার বারান্দার এক কোণে বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিলেন রাশিদা বেগম (৬০)। শহরের কলেজ রোডের বাসিন্দা রাশিদা বেগম আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। তাকাতেই বলে ওঠেন, ‘আমি এতিম অইগিছি। আমার বাবা মারা গেছইন। সেনবাবু আমারে মেয়ে ডাকতেন। বিপদে-আপদে তিনিই আমার সব ছিলেন।’ বারান্দার আরেক পাশে একজনকে ঘিরে আছে কিছু মানুষ। তাঁর কাছ থেকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মরদেহ কখন-কীভাবে, কারা দিরাইয়ে নিয়ে আসবেন,তা জানার চেষ্টা করছেন তাঁরা।
দিরাই শহরের চণ্ডীপুর গ্রামের বাসিন্দা ছাদউদ্দিন (৬৫) বলেন, সকাল হতে না হতেই লোকজন ছুটে আসছে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দিরাই-শাল্লার সব মানুষের নেতা ছিলেন। দলমত-নির্বিশেষে সবাই তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন। আজকে সবাই শোকাহত। তাঁর কথার ফাঁকে আলী আমজাদ (৭০) নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘১৯৬৯ সাল থেকে সেনবাবুর সঙ্গে আছি। কর্মীদের সন্তানের মতো ভালোবাসতেন তিনি। সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে পাশে থাকতেন। এ রকম নেতা আর হবে না।’
আবদুল মতলিব (৫৫) বলেন, ‘রাজনীতি করলেই মানুষের নেতা অওয়া যায় না। সেনবাবু আছলা সাধারণ মানুষের নেতা। তাইনের শরীরে মাটির গন্ধ আছিল। এর লাগি তাইন মানুষরে অত ভালোবাসতা। মানুষও তাইনরে ভালা পাইত।’
দোতলার বারান্দায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বেতের তৈরি যে চেয়ারটি বসতেন, সেটি পরিষ্কার করছিলেন সুবল পাল (৪৫)। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সম্পর্কে বলতে চাইলে তিনি কান্না শুরু করেন। কোনো কথা বলতে পারেননি। পাশে থাকা এক ব্যক্তি জানান, সুবল পাল ২০ বছর ধরে এখানে আছেন। তাঁর সংসার-সন্তান নেই, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তই সব ছিলেন। সকালে খবর জানার পর থেকেই তিনি কাঁদছেন। কারও সঙ্গে কোনো কথা বলছেন না।
হাওর-অধ্যুষিত দিরাই-শাল্লায় দূর থেকে আসা নেতা-কর্মী আর সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মো. ছইল মিয়া। তিনি জানান, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর মৃত্যুতে সুনামগঞ্জজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। দিরাইয়ে তিন দিনের শোক কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। সবাই কালো ব্যাজ পরেছেন। সবাই তাঁর বাসভবনে ছুটে আসছেন শেষবারের মতো প্রিয় নেতাকে এক নজর দেখার জন্য।
আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা ও সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আজ রোববার ভোররাতে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে মারা যান। তিনি হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) লাইফ সাপোর্টে ছিলেন।
Share this content: