জাতীয়বাংলাদেশলিড নিউজ

সাংবাদিকতা ও গুপ্তচরবৃত্তির পার্থক্য নিরূপণের দাবি

এবিএনএ : প্রস্তাবিত ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের কয়েকটি ধারা নিয়ে ১০টি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে সাংবাদিকদের জন্য বিশেষ সুরক্ষা দাবি করেছে সাংবাদিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)। সেই সঙ্গে গুপ্তচরবৃত্তির সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিয়ে সাংবাদিকতা ও গুপ্তচরবৃত্তির পার্থক্য নির্ধারণের দাবিও জানিয়েছে তারা। সোমবার সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছে এই পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তাব নিয়ে বৈঠক করেন সাংবাদিক নেতারা। প্রস্তাবিত জিডিটাল নিরাপত্তা আইনের ছয়টি ধারা নিয়ে দৈনিক পত্রিকাগুলোর সম্পাদকদের সংগঠন এডিটরস কাউন্সিলের সাম্প্রতিক বৈঠকের পর সরকারপন্থী সাংবাদিকদের সংগঠন এই বৈঠক করল। বিএফইউজে সাংবাদিক সুরক্ষার প্রস্তাব দিয়েছে, সেটা হলো আলোচিত ৩২ ধারা অনুযায়ী কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আগে বিষয়টি নিয়ে প্রেস কাউন্সিলের সঙ্গে আলোচনা করা।

সংগঠনের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘আমাদের প্রস্তাবনা হচ্ছে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার প্রয়োগের ক্ষেত্রে যেমন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের প্রয়োজন হয় তেমনি এ আইনটিও যদি গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে হয় প্রাথমিকভাবে প্রেস কাউন্সিলের নিয়ন্ত্রণে একটি কাউন্সিল থাকা জরুরি।’ ‘যেখানে সরকারের প্রতিনিধিরা থাকবেন, ডিইউজে ও গণমাধ্যম নেতৃবৃন্দ থাকবেন, তারা কোনো গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে চাইলে তারা যেন প্রাথমিক বিষয়গুলো বিবেচনা করেন।’ বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, প্রস্তাবিত আইনটি পাস করার আগে সংশোধন করা হবে। এ নিয়ে ভীত হওয়ার কারণ নেই।

‘আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, তাই গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য আমরা সবকিছু করব। আর এ আইনের যেখানেই সংশোধন করা প্রয়োজন হয় সেখানেই পরিবর্তন করা হবে। প্রস্তাব দানকারী সবগুলো সংগঠনের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করে আইনটি এমনভাবে সংশোধন করা হবে যাতে কেউ ভীত হবে না।’ ‘আমি ওনাদের বলেছি, এডিটরস কাউন্সিল, এ্যাটকো (বেসরারি টেলিভিশনের নির্বাহীদের সংগঠন) এবং বিএফইউজে এ আইনের বিষয়ে প্রস্তাব রাখতে চায় বা উদ্বেগ প্রকাশ করতে চায় এটি সংসদীয় কমিটি বিবেচনা করবে। বিষয়গুলো নিয়ে সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হতে পারে। সেখানে আলোচনা হলেই মনে হয় এর সব সমাধান হতে পারে।’ আজকে দেয়া বিএফইউজের প্রস্তাব আপনি যৌক্তিক মানেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘অবশ্যই যৌক্তিক মানি। আমি এর আগেও বলেছি।’ মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘আমাদেরকে বলা হয়েছিল আমাদের কোনো নির্দিষ্ট প্রস্তাবনা থাকলে তা যেন তাদের কাছে জমা দিই।’ ‘আমরা আমাদের প্রস্তাবনায় বলেছি, আইনটি সংসদে পাস হওয়ার পরে একটি প্রাতিষ্ঠানিক সেফটি নেট সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের জন্য থাকা উচিত।’

৩২ ধারায় ‘গুপ্তরচবৃত্তির’ সাজার বিষয়ে বিএফইউজে বলছে, ‘গুপ্তচর বৃত্তি সম্পর্কে প্রচলিত আইন থাকলে নতুন এই ধারার প্রয়োজন কী? সাংবাদিককতা আর গুপ্তচরবৃত্তির পার্থক্য নিরূপণ করা প্রয়োজন।’ গুপ্তচরবৃত্তির সংজ্ঞা স্পষ্ট করা প্রয়োজন। একজন সাংবাদিক একটি বিদেশি গণমাধ্যমের জন্য লেখা বা সম্প্রচারের জন্য খবর পাঠালে তা গুপ্তচরবৃত্তির আওতায় পড়বে কি না, সেটাও স্পষ্ট করার তাগাদা দেয় বিএফইউজে। গত ২৯ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন হওয়া আইনটি পাসের জন্য সংসদে তোলার প্রক্রিয়া চলছে। তবে অনুমোদনের পর থেকেই খসড়া আইনের ৩২ ধারা নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এই ধারাটির কারণে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে সমালোচনা করে আসছেন সাংবাদিকরা। এই ধারায় বলা আছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত বিধিবদ্ধ সংস্থার কোনো গোপনীয় বা অতি গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার বা ডিজিটাল ডিভাইস বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কে ধারণ, প্রেরণ, সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন তাহলে সেটা হবে গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ।’

এই ‘গুপ্তচরবৃত্তির’ সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছর জেল বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা জরিমানা। কেউ যদি এই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করেন, তাহলে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড ভোগ করতে হবে। বিএফইউজের তার পর্যবেক্ষণে ৩২ ধারা ছাড়াও ২১, ২৫, ২৮, ২৯ ও ৩১ ধারার অপপ্রয়োগের আশঙ্কা করে এগুলোর ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট করার প্রস্তাব করেছে। ২১ ধারায় মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে প্রচারণার বিষয়টি রাজনৈতিক বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কাজে ব্যবহার হতে পারে বলে শঙ্কিত বিএফইউজে। তারা ধারাটি আরও সুনির্দিষ্ট করে স্বাধীনতা, স্বার্বভৌমত্ব, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত কথাগুলো সংযুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছে। তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও আরও স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট করার কথা বলেছে। ২৫ ধারায় আক্রমণাত্মক মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক তথ্য উপাত্ত প্রেরণের ক্ষেত্রে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শনের মাত্রা কীভাবে বিবেচনা হবে, সেই প্রশ্নও তুলেছে বিএফইউজে। অপরাধের মাত্র বিবেচনার বিষয়টি নিশ্চিত করা না হলে আইনটির অপপ্রয়োগের আশঙ্কাও করেছে তারা। ২৮ ধারায় ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাতের বিষয়ে বিএফইউজে বলেছে, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। কারও ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত না করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আবার কারো নিজস্ব প্রচার ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বাধা আরোপ করা যাবে না।২৯ ধারা নিয়ে বিএফইউজে বলেছে, মানহানি বিষয়ে প্রচলিত আইন, বিধি আছে। কেনও নতুন করে এই বিধি কেন সংযোজন করতে হবে। প্রস্তাবিত আইনের ৩১ ধারাও সুনির্দিষ্ট নয় বলে মনে করে বিএফইউজে। তাদের শঙ্কা, এই ধারারও ব্যাপক অপপ্রয়োগ হবে।

Share this content:

Back to top button