আমেরিকা

এ এক অন্যরকম ভোট

এ বি এন এ : আধুনিক আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত নির্বাচনী প্রচারণা চলছে এবার। আর এতে দীর্ঘদিনের একটি বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সেটা হলো- ভোট না দেয়া কি নৈতিক? চার বছর আগের নির্বাচনে ৯ কোটি ২০ লাখ মার্কিনি ভোট দেননি। কিন্তু ট্রাম্প যুগের রাজনীতি অনেক সম্পাদকীয় লেখক, ডেমোক্রেটিক দলের অনুসারী এমনকি কিছু রিপাবলিকানকেও অনুপ্রাণিত করেছে। তারা যুক্তি প্রদর্শন করছেন, সম্ভাব্য কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে ডনাল্ড ট্রাম্প এতটাই অগ্রহণযোগ্য যে, তার বিরুদ্ধে ব্যালটে রায় দেয়াটা মার্কিন নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে পরিণত হয়েছে। ওদিকে, ট্রাম্প সমর্থক শিবিরের অনেকে হিলারি ক্লিনটনকে নিয়ে একই রকম মনে করছেন।
গত সপ্তাহে হিলারির এক প্রচারণা সভায় ফার্স্টলেডি মিশেল ওবামা বলেছেন, ‘একটা বিষয়ে স্পষ্ট হওয়া যাক: নির্বাচন শুধু কারা ভোট দেবেন তাদের নিয়ে নয়, বরং যারা ভোট দিচ্ছেন না তারাও গুরুত্বপূর্ণ।’ সতর্কবার্তা দিয়ে মিশেল বলেন, ‘আপনি যদি হিলারি ছাড়া অন্য কাউকে ভোট দেন বা আপনি যদি আদৌ ভোট না দেন তাহলে আপনি হিলারির প্রতিদ্বন্দ্বীকে নির্বাচিত করতে সহায়তা করছেন। আর এমনটা করার কোনো সুযোগ এবার নেই। কেননা ঝুঁকিটা অনেক বেশি।’ রিপাবলিকানদের উদ্দেশ্য করে রক্ষণশীল কলামিস্ট ডরোথি র‌্যাবিনোউইটজও একই রকম বার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘হিলারিবিরোধী শিবিরের অনেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, হিলারি ক্লিনটনকে ভোট দেয়ার তুলনায় বরং তারা বাড়িতে থাকবেন।’ ডরোথি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘সবচেয়ে ভারসাম্যহীন, অজ্ঞ এবং মানসিকভাবে অযোগ্য একজন প্রেসিডেন্টের হোয়াইট হাউজে প্রবেশের পথে একমাত্র যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি হলেন হিলারি ক্লিনটন।’
ওদিকে, ট্রাম্প শিবিরে নিউ জার্সির গভর্নর ক্রিস ক্রিস্টি এবং নিউ ইয়র্কের সাবেক মেয়র রুডি গিউলিয়ানি যুক্তি দেখাচ্ছেন যে, হিলারি নির্বাচিত হলে সেটা হবে জাতির জন্য হুমকিস্বরূপ। আর যেসব রিপাবলিকান ট্রাম্পের বিরোধিতা করেন তারা তৃতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থীকে ভোট দিতে বা ভোট না দিতে আহ্বান জানাচ্ছেন। রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতার দৌড়ে ছিটকে পড়া জেব বুশ সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, তিনি ভোট দেবেন তবে ট্রাম্প বা হিলারি ক্লিনটনকে নয়।
ট্রাম্পের মানসিক স্থিতি নিয়ে অনেক সিনিয়র রিপাবলিকান নেতাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মুসলিম-আমেরিকান গোল্ডস্টার পিতা-মাতাকে সমালোচনা করা, সাবেক এক বিশ্বসুন্দরীর বিরুদ্ধে গভীর রাতে টুইটার যুদ্ধ, ন্যাটো জোট নিয়ে সংশয় আর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রশংসা করা- ট্রাম্পের এসব কাণ্ডকারখানায় রিপাবলিকানদের মনে প্রশ্ন উঠেছে দেশের সর্বোচ্চ কার্যালয় নিয়ে ট্রাম্পকে বিশ্বাস করা যায় কিনা। সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ এবং ২০১২ সালের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মিট রমনি জানিয়ে দিয়েছেন, তারা ট্রাম্পকে ভোট দেবেন না।
ওদিকে হিলারিকে নিয়েও নানা উদ্বেগ রয়েছে কিছু ভোটারের মনে। তার সততা, বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে তাদের মনে। এসব ভোটার নিশ্চিত নন কাকে সমর্থন করা উচিত। আর এসবের ফলে লিবারটারিয়ান দলের প্রার্থী গ্যারি জনসনের সমর্থন বেড়েছে। দেশজুড়ে সাম্প্রতিক সব জরিপ মোতাবেক গড়ে ৭.৩ শতাংশ সমর্থন উপভোগ করছেন তিনি। যা কিনা ১৯৯৬ সালের স্বতন্ত্র প্রার্থী রস পেরোটের পর সর্বোচ্চ।
প্রশ্ন হলো- বড় দুটি দলের প্রার্থীই যখন বেশিরভাগ মার্কিনিদের কাছ থেকে নেতিবাচক রেটিং পাচ্ছেন তখন কি ভোটাররা বাড়িতে বসে থাকবেন?
ইতিহাস বলে, অনুপ্রেরণা সৃষ্টিকারী প্রার্থীরা ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে টেনে আনতে সবচেয়ে সফল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশি ভোটার উপস্থিতি ছিল ১৯৬০ সালে। সেবার ম্যাসাচুসেটসের প্রাণোচ্ছল উদীয়মান সিনেটর জন এফ. কেনেডি সামান্য ব্যবধানে জয়ী হন। এরপর কয়েক দশক ধরে নিয়মিত ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার পর ২০০৮ সালে এসে পুনরায় বেড়ে দাঁড়ায় ৬১.৬ শতাংশ। এ দফায় ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের সিনেটর বারাক ওবামা দেশের প্রথম আফ্রিকান আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
পণ্ডিত ব্যক্তিরা বলছেন, ‘ভয়’ অনেক সময় ‘প্রত্যাশা’র মতোই আকর্ষণ সক্ষম হয়ে উঠতে পারে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের প্রেসিডেন্ট মাইকেল ডিমক বলেন, ‘ভয় অনেক বড় অনুপ্রেরণা সৃষ্টিকারী, ঠিক প্রবল উৎসাহ যেমন অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে। পিউ রিসার্চ সেন্টার ভোটার ও নন-ভোটারদের নিয়ে গবেষণা করেছে। ১৯৯৬ ও ২০০০ সালের মতো বছরগুলোতে ভোটার উপস্থিতি কমেছিল। এ বছরগুলোতে ভোটাররা মনে করেননি ঝুঁকি অনেক বেশি বা বড় দুই প্রার্থীর মধ্যে পার্থক্য অনেক বেশি। দুটোর কোনোটাই এবারের নির্বাচনে প্রযোজ্য নয়। এ বছর বেশিমাত্রার আগ্রহ বেশি ভোটার উপস্থিতির সংকেত হতে পারে। পিউর সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ১০ জনে ৮ জনের বেশি বলেছেন, প্রার্থীরা কি বলছেন তা তারা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। গত ২৫ বছরের মধ্যে নির্বাচনের প্রার্থীদের নিয়ে এবারই ভোটারদের আগ্রহের মাত্রা সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে।  প্রতি ১০ জনে ৮ জন বলেছেন, তারা এবারের নির্বাচন নিয়ে বেশ অনেকখানিই ভেবেছেন। ৪ জনে একজন বলেছেন, এবারে কে জিতবে সেটা তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আবার দুই-তৃতীয়াংশ বলেছেন, এবারের নির্বাচনী প্রচারণার ধাঁচ অনেক বেশি নেতিবাচক। ১০ জনে মাত্র ৪ জন বলেছেন তারা তাদের পছন্দ নিয়ে সন্তুষ্ট নন। যা কিনা দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। প্রতি ১০ জনের মাত্র ১ জন বলেছেন, শীর্ষ দুই প্রার্থী ভালো প্রেসিডেন্ট হবেন। ১০ জনে ৪ জন বলেছেন, দুজনের কেউই ভালো প্রেসিডেন্ট হবেন না।
ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার রাজনৈতিক বিজ্ঞানি মাইকেল ম্যাকডোনাল্ড বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট পদে আমরা কখনও এমন প্রার্থীদের দেখিনি। আমার ধারণা হলো, মানুষ এবার তার অপছন্দের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ভোট দিতে আগ্রহী হবে। তারা হয়তো তাদের প্রার্থীকে অতটা পছন্দ করে না। তবে তারা নিশ্চিতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে পছন্দ করেন না।’
জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং ‘দ্য এথিকস অব ভোটিং’ বইয়ের লেখক জেসন ব্রেনান বলেন, ‘বেশিরভাগ মার্কিনি মনে করেন ভোট দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।’
২০১২ সালে লাতিনো ভোটার এবং ৩০-এর কম বয়সী ভোটারদের বেশিরভাগ  ভোটকেন্দ্রে যায়নি। দুটো গ্রুপই ট্রাম্পের তুলনায় হিলারিকে সমর্থন করেন। আর নির্ধারণী অঙ্গরাজ্য বিবেচিত কলোরাডো, ভার্জিনিয়া, ফ্লোরিডা ও নেভাডাতে তাদের অবস্থান রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। এ কারণেই ডেমোক্রেটিক শিবির ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য রিপাবলিকানদের চেয়ে বেশি তৎপর।
যারা ভোটকেন্দ্রে এসে ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকেন তারা যে শুধু আদর্শিক জায়গা থেকে এমনটা করেন তা নয়। এমন ভোটাররা বলেন, তারা অনেক বেশি ব্যস্ত বা তারা দুই প্রার্থীর কাউকে পছন্দ করেন না বা তারা এটা মনে করেন না যে তাদের ভোট দেয়া না দেয়ায় কিছু যায় আসবে। রাজনীতি নিয়ে তারা কম আগ্রহ প্রকাশ করেন।
আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের বর্ষীয়ান রাজনৈতিক বিশ্লেষক নরম্যান ওর্টস্টেইন বলেন, ‘আমি দ্য আরিজোনা রিপাবলিক, দ্য ডেট্রোয়েট নিউজ এবং এমন অন্যদের অবস্থানের সঙ্গে একমত যে, ডনাল্ড ট্রাম্প বিরল ধরনের প্রার্থী, যিনি আমাদের মৌলিক জীবনধারার ওপর বিরল ধরনের হুমকি।
ইউএসএ টুডে অতীতে কখনও কোনো প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে সমর্থন করেনি। শুক্রবার দৈনিকটি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে আহ্বান জানিয়েছে বা অন্য কাউকে সমর্থন করার আহ্বান জানিয়েছে।
[ইউএসএ টুডের ওয়াশিংটন ব্যুরো চিফ সুজান পেইজের লেখা ‘এ শার্পেন্ড ডিবেট: ইজ ইট এথিক্যাল টু নট ভোট দিস ইয়ার ফর প্রেসিডেন্ট’ শীর্ষক নিবন্ধের ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ। সুজান পেইজ এবারের নির্বাচন নিয়ে নবম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাভার করছেন। বিগত ৮ প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তিনি। আর সংবাদ প্রতিবেদন করেছেন ৫টি মহাদেশ থেকে।]

Share this content:

Related Articles

Back to top button