এবিএনএ : জ্ঞান অর্জনের দুটি উপায় রয়েছে। একটি হলো ভ্রমণ করে অন্যটি হলো বই পড়ে। ভ্রমণের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করতে হলে বিত্তশালী হতে হবে। কেননা, ভ্রমণ করতে প্রচুর টাকা পয়সার প্রয়োজন। আর তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে আমাদের দেশের জনসাধারণের মধ্যে প্রায় ১৭ ভাগই দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। এছাড়া অনেকের বিত্ত আছে চিত্ত নেই। বিধায় আমাদের দেশের কথা মাথায় রেখে ভ্রমণ করে জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমকে প্রাধান্য না দিয়ে, আমাদেরকে জ্ঞান অর্জনের জন্য জ্ঞানের অন্যতম মাধ্যম বই এর আশ্রয় নিতে হবে। জসীমউদ্দীন এর ভাষায় বলতে হয়, “বই আপনাকে অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ সকল কালে নিয়ে যেতে পারে। যে দেশে আপনার কোনোদিন যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, বইয়ের রথে চেপে আপনি অনায়াসে সে দেশে যেতে পারবেন”। আর বই এর রাজ্য হলো গ্রন্থাগার। গ্রন্থের শ্রেণিবদ্ধ সংগ্রহকে গ্রন্থাগার বলা হয়। সাধারণ অর্থে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের তথ্য সেবা ও সুশিক্ষার জন্য জ্ঞানের সকল তথ্য ও উপাত্ত পদ্ধতিগত ভাবে যেখানে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয় তাকে গ্রন্থাগার বলে। অর্থাৎ যে প্রতিষ্ঠানে তথ্য সামগ্রী যেমন,বই,জার্নাল, গ্লোব, ম্যাপ ইত্যাদি পদ্ধতিগত ভাবে সংগ্রহ ও সংরক্ষিত থাকে এবং পাঠকদের প্রয়োজন মত সেবা প্রদান করে থাকে তাকে অর্থাৎ যে প্রতিষ্ঠানে তাৎক্ষনিক ব্যবহারের জন্য অথবা ভবিষ্যৎ ব্যবহারের জন্য পদ্ধতিগত ভাবে বই,পত্রপত্রিকা, পাণ্ডু্লিপি, সাময়িকী, জার্নাল ও অন্যান্য তথ্য সামগ্রী নিয়মিত সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও সুশৃঙ্খল পাঠের ব্যবস্থা করা থাকে যে প্রতিষ্ঠানে তাকেই গ্রন্থাগার বলে। গ্রন্থাগার হলো একটি উন্মুক্ত বিদ্যাপীঠ । এখানে যেকোন বয়সের, যে কোন পেশার লোক পড়াশোনা করে জ্ঞান অর্জন করতে পারেন। একটি গ্রন্থাগারে খুব সহজে জনসাধারণ জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পায় অতি অল্প পরিশ্রমে নামেমাত্র বিনিময়ে। আবার কোন কোন গণগ্রন্থাগারে বিনিময় বা সার্ভিস চার্জ নেওয়া হয়না। একটি জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ধর্মসহ পুরাতন ও নিত্যনতুন তথ্য জানতে গ্রন্থাগারের বিকল্প নেই। কেননা গ্রন্থাগারের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Library যা ব্যাখ্যা করলে পাওয়া যায়, L- Latest, I-Information, B- By, R- Research, A – And, R- Reference, Y – You অর্থাৎ Latest Information By Research And Reference For You. এবার আলোকপাত করা যাক গ্রন্থাগারের প্রকারভেদ নিয়ে। জ্ঞান অর্জনের দিক থেকে গ্রন্থাগার চার প্রকার। যথা: জাতীয় গ্রন্থাগার, গণগ্রন্থাগার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগার ও বিশেষ গ্রন্থাগার। এছাড়াও ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকে পারিবারিক গ্রন্থাগার গড়ে তুলেন। গ্রন্থাগারে একজন পাঠক স্বাধীন ভাবে যেকোন ধরনের রুচিশীল বই পড়তে পারেন। কারণ গ্রন্থাগারের বুকশেলফে বিভিন্ন মতের লেখকের বই পাশাপাশি অবস্থান করে কোনও ধরনের ঝামেলা ছাড়াই। এ থেকেই প্রমাণিত হয় গ্রন্থাগার এক সম্প্রীতির স্থান। একটি জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য তথা কৃষ্টি-কালচারের সংগ্রাহক, সংরক্ষক, ধারক ও বাহক হলো একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার। একথা আমরা যেনো ভূলে না যাই। গ্রন্থাগার ও সমাজ এ শব্দ দুটি একে অপরের পরিপূরক। গ্রন্থাগার হলো যৌগিক সংস্কৃতির সুতিকাগার যা সমাজেরই সৃষ্টি।এবং সমাজের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আমাদের দেশে সমাজ উন্নয়নে ও জাতীয় সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি গ্রন্থাগার যেসব ভূমিকা পালন করে থাকে। তাহলো : গ্রন্থাগার একটি জাতির সভ্যতার ধারক ও বাহক। গবেষণায় গ্রন্থাগার। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার সহযোগিতায় গ্রন্থাগার। গণশিক্ষায় গ্রন্থাগার। জাতীয় উন্নয়নে গ্রন্থাগার। রেফারেন্স সেবায় গ্রন্থাগার। জাতীয় সংহতির ক্ষেত্রে গ্রন্থাগার। এছাড়া ও গ্রন্থাগার সমাজের উন্নয়নে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে। যেমন : গ্রন্থাগার সার্বক্ষণিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে শিক্ষালাভের সুযোগ করে দেয়। গ্রন্থাগার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সমাজের সকল স্তরের মানুষের মধ্যে মূল্যবোধ সৃষ্টিতে সহায়তা করে। সমাজের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গ্রন্থাগার এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সমাজের সংস্কৃতির বিকাশে গ্রন্থাগার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তথ্য সরবরাহে গ্রন্থাগার গুরুত্বপূর্ণ অবদান পালন করে থাকে। শিক্ষিত ও সচেতন জাতি গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে। সমাজে অনেক মানুষ আছেন যারা নিজ নিজ পেশায় কীর্তিমান, কিন্তু সামাজিক বিষয়ে সম্পূর্ণ আনাড়ি। গ্রন্থাগার তাদের আনাড়িপনা দূর করতে সহায়তা করে। গ্রন্থাগার নানারকম শিক্ষা মূলক কর্মসূচির আয়োজন করে সমাজ থেকে অজ্ঞতা ও কুসংস্কার দূরীভূত করে থাকে। পরিবেশ সংরক্ষণ, স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়ে অবগত করতে পারে। অশিক্ষিত ও স্বল্প শিক্ষিত মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে এবং জনসাধারণের ভ্রান্ত ধারনা দুরীভূত করে আধুনিক সমাজ গঠনে গ্রন্থাগার অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রন্থাগার সমাজ উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে। সামাজিক অবক্ষয় রোধ তথা বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, যৌতুক প্রথা ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে গ্রন্থাগার বিশেষ অবদান রাখে। সমাজের সকল মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করে সামাজিক অবক্ষয় দূর করে সমাজে উন্নততর জীবন যাপনের পরিবেশ সৃষ্টি করে।
প্রাচীন কাল থেকেই দেখা যায় সমাজে গ্রন্থাগারের কদর রয়েছে। তৎকালীন রাজা বাদশারা নিজ নিজ দায়িত্বে গ্রন্থাগার গড়ে তুলেছেন। মন্দির, গির্জা ও অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ের একটি কোনে ধর্মীয় বই-পুস্তকসহ রাজকীয় ফরমান ও বংশ তালিকা গুরুত্ব সহকারে সংরক্ষণ করতেন বংশ পরস্পরায়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, যেদিন থেকে মানুষ লিখিত উপাত্ত গুলো দীর্ঘস্থায়ী সংরক্ষনের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে সংরক্ষণ করতে থাকে সেদিন থেকেই গ্রন্থাগারের মত সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উৎপত্তি শুরু হয়। আর এভাবেই সমাজে গ্রন্থাগার গড়ে উঠে। তৎকালীন সময়ে গড়ে তোলা কয়েকটি গ্রন্থাগারের নাম এখানে উল্লেখ না করে পারছি না। যেমন, আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগার, ভারতীয় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার ইত্যাদি। এগুলি গড়ে উঠেছিল তৎকালীন রাষ্ট্র প্রধানদের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায়। এ থেকে প্রমাণ হয় তৎকালীন সময়েও সমাজ উন্নয়নে গ্রন্থাগারের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়।
সমাজে যে হারে সন্ত্রাস,অন্যায়,অবিচার বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার মূলে রয়েছে গ্রন্থাগার বিমুখতা।
বর্তমানে যেভাবে আমাদের যুব সমাজ অপসংস্কৃতির দিকে ধাবিত হচ্ছে এ থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো যুব সমাজকে জ্ঞানচর্চা তথা গ্রন্থাগারমুখী করে তোলা। অত্যন্ত দূঃখের সাথে বলতে হয় আমাদের দেশের জেলা পর্যায়ের অনেক গণগ্রন্থাগারও সঠিক পরিচর্যা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে বা বন্ধ হবার উপক্রম। একইভাবে সব উপজেলা সদরেও গণগ্রন্থাগার জোরেশোরে গড়ে উঠেনি। আর গড়ে উঠলেও পরিচর্যা, পেশাগত গ্রন্থাগারিক না থাকা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অনেকটি বন্ধ হয়ে গেছে বা কার্যক্রম স্থবির হয়ে গেছে। এখানে একটি কথা উল্লেখ না করে পারছি না সীমিত আকারে হলেও বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্র জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। যা সময়ের দাবিতে একেবারেই অল্প। তাই সরকারের প্রতি বিনীত নিবেদন যে, প্রতিটি জেলা সদর, উপজেলা সদর ও ইউনিয়ন পর্যায়ে একটি করে সমৃদ্ধ গণগ্রন্থাগার গড়ে তুলুন। কারণ এদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিকে আমরা ভালোবাসি। দেশটা গড়েছেন আমাদের পূর্বসূরি, এখন কাজ করছি আমরা,ভবিষ্যৎ এ কাজ করবে আমাদের উত্তরসূরিরা। তাই সরকারের পাশাপাশি জনসাধারণকেও গ্রন্থাগার উন্নয়নের মাধ্যমে দেশ ও জাতির উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে।
সুতরাং একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, সমাজ উন্নয়নে গ্রন্থাগারের বিকল্প নেই। অর্থাৎ সমৃদ্ধ দেশ ও জাতি গঠনে গ্রন্থাগারের বিকল্প নেই। তাই আসুন দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে, সরকার ও জনসাধারণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পাড়ায় পাড়ায় গ্রন্থাগার গড়ে তুলতে না পারলেও অন্তত ইউনিয়ন পর্যায়ে একটি করে গণগ্রন্থাগার গড়ে তুলি।