এবিএনএ : লেখাটি লিখতে গিয়ে ছেলে বেলার একটি ভাল লাগার কবিতার কথা মনে হল। কবিতাটির দুটি লাইন এমন-
বাঁশ বাগানে মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ঐ
মাগো আমার শোলক বলার কাজলা দিদি কই।
কবিতাটি পড়ে মায়ের গলায় জড়িয়ে ধরে বলতাম কাজলা দিদি কই। মায়ের তখন নানা কথা, আকাশে, নদীর ধারে, তারার মাঝে। যত বারই কবিতাটি পড়া হত, তত বারই মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলা যেত কাজলা দিদি কই। বাবা মাঝে মাঝে বলতেন তোমার এই কবিতা ছাড়া আর পড়া নেই। কিন্তু বাবা কি বুঝত কবিতা পড়ার সাথে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরার সম্পর্ক আছে। কিন্তু মা ঠিকই বুঝত। একজন মা তার সন্তানকে যতটুকু বুঝতে পারে ততটুকু আর কেউ পারে না। একজন সন্তানের ব্যথায় মা যতটুকু ব্যথিত হয় ততটুকু আর কেউ ব্যথিত হয় না। একটি ছোট ঘটনা বললে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। একদিন একজন সন্তান সম্ভবা মা ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার তাকে তার সমস্যা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন, “ ডাক্তার সাব আমার পেটের বাচ্চা প্রতিদিন এই আমার পেটে নড়াচড়া করে আর লাথি মারে, আমি তা বুঝতে পারতাম। কিন্তু কয়দিন হয় কোন নড়াচড়া বুঝতে পারি না, লাথিও মারে না। ডাক্তার হতবাক হলেন মাতৃত্বের এমন রূপ দেখে, বাচ্চা পেটে লাথি মারে তাতেও তার কষ্ট নেই। বাচ্চাটা নড়ছে না কেন তার জন্য দুশ্চিন্তার শেষ নেই। মা বলেই এমনটি সম্ভব। একজন মায়ের কাছে তার সন্তানের চেয়ে বড় কিছু নেই। সন্তান ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, দেশ বরেণ্য ব্যক্তি হল, নাকি গরিব হল কিংবা বড় হয়ে গেল, এসব বিবেচ্য নয়। মায়ের কাছে সন্তান যত বড় হোক সবসময় ছোট শিশু থাকে। যেমন আমার েেত্র তাই। আমি এখন চাকুরীর সুবাধে সিলেট থাকি। যখন বাড়ি যাই তখন মা আমায় স্নান করিয়ে দিবে। আমার কাতু কুতু লাগে কিংবা আমি অনেক বড় হয়েছি সেদিকে তার খেয়াল নেই। এখনও তার কুলে মাথা রেখে ঘুমনোর মত সুখ আর কোথাও পাই না। বাবার েেত্র তা হয় না। সন্তান বড় হলে বাবার কাছ থেকে কিছুুটা দুরে সরে যায়। বাবা তার সন্তানের সাথে কথা বলতে বা কোন দরকার থাকলে, এই যে তোমার সাথে একটু কাজ আছে। কেমন জানি পর-পর, আনুষ্ঠানিকতায় মোড়ানো। কিন্তু মায়ের সাথে আনুষ্ঠানিকতার স্থান নেই। মা এতই কাছের যে, অনেক সময় নিজেকে নিজের পর ভাবা যায়, কিন্তু মাকে না। হুমায়ুন আজাদের একটি কবিতার কয়েকটি লাইন এমন-
আমার মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি/আমাদের মা ছিলো আমাদের শ্রেনির/ আমাদের বর্ণের, আমাদের গোত্রের/বাবা ছিলেন অনেকটা আড়িয়াল বিলের প্রচন্ড চিলের মতো, তার ছায়া দেখলেই মুরগির বাচ্চার মতো আমরা মায়ের ডানার নিচে লুকিয়ে পরতাম/ ছায়া স’রে গেলে বের হয়ে আকাশ দেখতাম/আমাদের মা ছিলো ধান তে-সোনা হ’য়ে দিকে দিকে বিছিয়ে থাকতো/আমাদের মা ছিল দুধভাত-তিনবেলা আমাদের পাতে ঘন হয়ে থাকতো/আমাদের মা ছিল ছোট্ট পুকুর- আমরা তাতে দিন রাত সাঁতার কাটাতাম। মা এমন এই। কিন্তু বর্তমান কালে যখন দেখি এই মা এই লাঞ্চিত হন, অবহেলিত হন, তার সন্তানের কাছে তখন হতবাক হই। এখন ছেলে বড় হয়ে বিয়ে করলে তার বউ এর কথায় মাকে ভূল বোঝে। কোন কোন েেত্র নির্যাতন ও করে। আমি এমনও দেখেছি কোন মায়ের যোগ্য পাঁচ সন্তান আছে। তারা স্ব-স্ব েেত্র প্রতিষ্ঠিত। বিয়ের পর তারা নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত, কেউ বৃদ্ধা মায়ের খবর রাখে না। মা তার জীবিকা নির্বাহের জন্য অন্য বাড়িতে কাজ করে। কিন্তু ওরা ভূলে যায় একদিন ওদের সন্তানও বিয়ে করবে, তখন তাদের অবস্থা এমন হবে। একজন সন্তান যদি তার মাকে সুখী রাখে, তার কোন দুঃখ থাকবে না এটা নিশ্চিত। একজন সন্তান যদি তার মাকে চিনতে পারে বা মায়ের মন জয় করতে পারে তার আর বিশ্ব চেনার দরকার নেই। হিন্দু ধর্মে একটি ছোট গল্প আছে। গল্পটি এমন- মা দূর্গার দুই সন্তান গণেষ ও কার্তিক। গণেষের বাহন ঈঁদুর এবং কার্তিকের ময়ূর। একদিন মা দূর্গা দুই সন্তানকে ডেকে বললেন তোমারে মধ্যে যে প্রথম বিশ্বঘুরে আমার কাছে আসবে আমি তাকে আমার গলার রত্মের হার দিব। কার্তিক ময়ূর নিয়ে বিশ্ব ঘুরতে বের হয়ে যান। এদিকে গণেষ তার মাকে প্রদণি করে বলেন, “আমি বিশ্ব ঘুরে এসেছি।” আমাকে রতেœর হার দাও। মা দূর্গা গণেশের মাতৃভক্তি দেখে মুগ্ধ হন এবং গণেষকে রত্মের হার উপহার দেন। একজন সন্তানের কাছে মায়ের চেয়ে বড় বিশ্ব আর কিছুই হতে পারে না। মা শব্দটির ছেয়ে বড় কিছু নেই। ছোট্ট সময় ছিলাম একটি কবিতা পড়েছিলাম-
মা কথাটি ছোট্ট অতি/কিন্তু যেন ভাই/ইহার চেয়ে নাম যে মধুর/ত্রিভুবনে নাই।
“মা” শব্দটি ছোট্ট কিন্তু ভালবাসায় ও গভীরতায় এর চেয়ে বড় শব্দ পৃথিবীতে নেই। “মা” দিবসে আমাদের সকলের এই প্রতিজ্ঞা হউক- “মায়ের প্রতি আমরা সব পরিবেশে সবসময় শ্রদ্ধাশীল থাকি। তার প্রতি কর্তব্য পালনে যেন পিছপা না হই।
লেখক :- কলামিষ্ট ও সংস্কৃতি কর্মী