এবিএনএ : লুই আই কানের করা সংসদ এলাকাসহ পুরো আগারগাঁও এলাকার মূল নকশা বুঝে পেয়েছে জাতীয় সংসদ সচিবালয়।
বৃহস্পতিবার (০১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া ইউনির্ভাসিটির আর্কাইভ থেকে পাঠানো নকশাগুলো হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়। সেখান থেকে নকশাগুলো জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
সন্ধ্যা ছয়টার দিকে জাতীয় সংসদের অতিরিক্ত সচিব আ ই ম গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘নকশা হাতে পেয়েছি, এখন স্পিকারের কাছে বুঝিয়ে দিচ্ছি’।
স্থাপত্য অধিদফতরের প্রধান স্থপতি কাজী গোলাম নাসির জানান, ‘আজই নকশা যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে এসেছে। আমাদের প্রয়োজনীয় সব নকশা একবারে বাক্স ভর্তি করে পাঠানো হয়েছে’।
এর আগে জাতীয় সংসদের অতিরিক্ত সচিব আ ই ম গোলাম কিবরিয়ার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে নকশা নির্ধারিত করে দিয়ে আসেন।
সে সফরের পর জানানো হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রে সংরক্ষিত ৮ হাজার নকশার মধ্যে ৮৩৫টি রয়েছে সরাসরি সংসদ সচিবালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এসব নকশা চার সেট করে আনা হবে।
সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া ইউনিভার্সিটির আর্কাইভে ৮ হাজার নকশা রয়েছে বলে বাংলাদেশের স্থপত্য অধিদফতরকে জানানো হয়েছিল। এর মধ্যে ৮৫৩টি নকশার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ওই ৮৫৩টি নকশাই সংগ্রহ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া আরও ৫৬টি ডকুমেন্ট রয়েছে, সেগুলোও আনার সিদ্ধান্ত ছিলো।
লুই আই কানের প্রতিটি নকশার জন্য খরচ পড়েছে ১৯ ডলার।
সংসদ ভবনের নকশা সংগ্রহের বিষয়টি অনুধাবন করে সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি লুই আই কানের মূল নকশা সংগ্রহের নির্দেশ দেন সংসদ সচিবালয়কে। ২০১৫ সালের ১৩ অক্টোবর একনেক বৈঠকেও লুই আই কানের মূল নকশা আনার নির্দেশনা দেন তিনি। কেননা, মূল নকশা হাতে না থাকায় সচিবালয় সেগুনবাগিচা থেকে আগারগাঁওয়ে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারছে না সরকার।
এখন আগারগাঁওয়ে সচিবালয় স্থানান্তর এবং জিয়াসহ অন্যদের কবর সরাতে আর বাধা রইল না।
সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৪ সালে লুই আই কান যখন মূল নকশাটি করেন, তখন ২৭টি মন্ত্রণালয়ের জন্য এ পরিকল্পনা করেন। তখন সেখানে মসজিদ ছিল, মাঝে বাগান ছিল, চন্দ্রিমা উদ্যানের ওখানে একটি বড় সড়ক ছিল, এর সামনে লেক ছিল, এরপর সংসদ ভবন ছিল। তাই অনুলিপি ধরে নয়, ১৯৭৪ সালের মূল নকশা ধরে সচিবালয়সহ সবকিছু করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
১৯৭৪ সালে শেরেবাংলা নগরে ৪২ একর জায়গায় জাতীয় সচিবালয় নির্মাণের জন্য সরকার ও মার্কিন কোম্পানি ডেভিড উইসডম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের সঙ্গে চুক্তি হয়। পরে এর কোনো অগ্রগতি হয়নি। ওই এলাকায় এরই মধ্যে ১০ একর জমিতে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। জমি কমে যাওয়া এবং বর্তমানের চাহিদা বিবেচনায় লুই আই কানের নকশা কিছুটা সংশোধন করেছে স্থাপত্য অধিদফতর।
নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে সংসদ ভবন এলাকার ভেতরেই গড়ে তোলা হয় জিয়াউর রহমানের মাজার ও কবরস্থান। এর মধ্যে সংসদ ভবনের উত্তরে ৭৪ একর জায়গা জুড়ে নির্মিত চন্দ্রিমা উদ্যানের মাঝখানে বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে তোলা হয় জিয়ার মাজার কমপ্লেক্স। আর জিয়া ও এরশাদের শাসনামল মিলিয়ে সংসদ ভবনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের পশ্চিম প্রান্ত লাগোয়া স্থানে পাঁচ বিঘারও বেশি জায়গাজুড়ে ‘জাতীয় কবরস্থান’ নাম দিয়ে আরো অন্তত সাতজনকে সমাধিস্থ করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, লুই আই কানের মূল নকশার প্রথম ধাপ ছিল ২০৮ একর জায়গার ওপর জাতীয় সংসদ ভবন নির্মাণ। যার সামনে ও পেছনে বিস্তীর্ণ সবুজ খোলা মাঠ থাকবে। চারদিকে আট লেনের সড়ক, মাঝখানেও লেক। দ্বিতীয় ধাপে লেকের পর থাকবে বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ। বাকি জায়গায় গড়ে তোলা হবে সচিবালয়, লাইব্রেরি, জাদুঘর, হাসপাতালসহ প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক বলয়।
লুই আই কানের নকশা ক্ষত-বিক্ষত করার প্রক্রিয়া এখানেই থেমে থাকেনি। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। ওই সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী হন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। লুই আই কানের নকশা উপেক্ষা করে আসাদ গেটের উল্টো দিকে অবস্থিত সংসদ ভবনের জায়গায় একটি পেট্রোল পাম্প স্থাপনের জন্য তিনি তার ছোট ভাই মির্জা খোকনকে জায়গা বরাদ্দ দেন।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মাঝামাঝি সময়ে আরও এক দফা ক্ষত-বিক্ষত করা হয় লুই আই কানের মূল নকশা। ওই সময় সংসদ ভবনের মূল ভবনের পাশেই খোলা সবুজ চত্বরে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন নির্মাণ করা হয়।
১৯৬১ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের আমলে বর্তমান সংসদ ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হয়। সে সময় স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে এ ভবনের স্থপতি নিয়োগ করা হয়। তার প্রস্তাবেই লুই আই কান এ প্রকল্পের প্রধান স্থপতি হিসেবে নিয়োগ পান।
দীর্ঘ সাধনার পর ১৯৮২ সালের ২৮ জানুয়ারি সংসদ ভবনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়।