এ বি এন এ : বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতে মানিক মিয়া এক প্রবাদপ্রতিম পুরুষ। বাংলাদেশে (তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান) তার হাত ধরেই সাংবাদিকতা এক নতুন মোড় নিয়েছিল। তিনি তথাকথিত নিরপেক্ষতার বদলে মানুষের মুক্তির পক্ষেই নিজেকে, সাংবাদিকতাকে নিয়োজিত করেছিলেন। কোনো মতবাদ প্রচার নয়, সাংবাদিকতার একমাত্র ও প্রধান লক্ষ্য যে গণমানুষের মুক্তির জন্য নিয়োজিত থাকা, ন্যায়ের প্রশ্নে অবিচল থাকা— এই কথা তিনি তাঁর সারাজীবনের কাজ দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন। দৈনিক ইত্তেফাক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাংবাদিকতাকে অবলম্বন করে জীবনব্যাপী তিনি এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
গণমুখী সাংবাদিকতার পথিকৃত্ ব্যক্তিত্ব তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৬৯ সালের এই দিনে মাত্র ৫৮ বছর বয়সে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ক্ষণজন্মা এই সাংবাদিক। নীতির প্রশ্নে, বাংলার মানুষের অধিকারের বিষয়ে মানিক মিয়া কখনো আপস করেননি। দৈনিক ইত্তেফাক ছিল তাঁর সেই সংগ্রামী জীবনের প্রধান হাতিয়ার। দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, প্রবাদপ্রতিম এই ব্যক্তিত্ব দেশের সাংবাদিকতাকে একটানে বদলে দিয়েছিলেন। মানুষের প্রত্যাশা, বেদনাকে জোরালোভাবে তুলে ধরবার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তাঁর।
ইত্তেফাক তথাকথিত নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা করেনি। মানুষের মুক্তির পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়েছে জাতির প্রতিটি ক্রান্তিকালে। মানিক মিয়া ছিলেন তার কাণ্ডারি। ইত্তেফাক পূর্ব পাকিস্তানে যে ভূমিকা পালন করেছিল তা ছিল সময়ের দাবি। সেসময় দৈনিক ইত্তেফাক ও মানিক মিয়ার অবস্থান এবং আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান ছিল এক ও অভিন্ন। শোষণ-বঞ্চনা, সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী আচরণের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের পক্ষে মানিক মিয়ার কলম ছিল সোচ্চার।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ইত্তেফাককে বলেন, ‘আজ যে স্বাধীনতার সোনালী ফসল আমরা ঘরে তুলছি সেজন্য ইত্তেফাক এবং মানিক মিয়ার একক অবদান অসাধারণ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ইত্তেফাক একটি অবিস্মরণীয় নাম হয়ে থাকবে। আজকের সাংবাদিকতায় বাণিজ্য ও মুনাফা প্রধান লক্ষ্য, কিন্তু সে যুগের সাংবাদিকতায় আদর্শ এবং তার জন্য লড়াই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। সাংবাদিকদের গাড়ি-বাড়ি ছিল না কিন্তু ছিল অটুট আদর্শ, নিষ্ঠা। মানিক মিয়া শুধু সংবাদপত্রের মালিক ছিলেন না, ছিলেন জনজীবনভিত্তিক সাংবাদিকতার পথিকৃত্।’
দৈনিক ইত্তেফাকের অঙ্গসজ্জায় আজ আমূল পরিবর্তন এসেছে, হয়ে উঠেছে আধুনিক। সাধু ভাষার বদলে চলিত ভাষাকে গ্রহণ করা হয়েছে সময়ের দাবি মেটাতে। কিন্তু সম্পাদকীয় নীতি আজো মানিক মিয়ার প্রদর্শিত পথেই পরিচালিত হচ্ছে। গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠন এবং বাংলাদেশের মানুষের অধিকারের প্রশ্নে ইত্তেফাকের অবস্থান প্রতিষ্ঠার পর থেকে একই রয়েছে।
রাজনৈতিক জগতে মানিক মিয়া ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য। ঘনিষ্ঠ ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। ‘আমার মানিক ভাই’ শিরোনামে এক লেখায় বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেছিলেন, ‘… আমার ব্যক্তিগত জীবনে মানিক ভাই’র প্রভাব যে কত গভীর, তা ভাষায় ব্যক্ত করার মত নয়। ১৯৪৩ সাল থেকে তাঁর সাথে আমার পরিচয়। সে পরিচয়ের পর থেকে সারাটা জীবন আমরা দু’ভাই একসাথে জনগণের অধিকার অর্জনের সংগ্রাম করেছি। … একটা বিষয়ে আমরা উভয়ই একমত ছিলাম। এবং তা হল, বাংলার স্বাধীনতা। স্বাধীনতা ভিন্ন বাঙালির মুক্তি নেই, এ বিষয়ে আমাদের মাঝে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ ছিল না। আর ছিল না বলেই নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও দু’জন দু’ফ্রন্টে থেকে কাজ করেছি। আমি কাজ করেছি মাঠে-ময়দানে আর মানিক ভাই তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর সাহায্যে।’
শুধু সাংবাদিক কিংবা রাজনীতির পথপ্রদর্শকই নন, মানুষ হিসাবেও তিনি ছিলেন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তাঁর সংস্পর্শে যিনি একবার এসেছেন তিনি তাঁর সম্মোহনী ব্যক্তিত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। মানিক মিয়া ছিলেন উদার গণতন্ত্রের ধারক। একজন রাজনীতিমনস্ক সাংবাদিক হয়েও তাঁর রাজনৈতিক কোনো উচ্চাভিলাষ ছিল না, ছিল না ব্যক্তিগত কোনো লোভ। এ কারণেই সত্ ও নির্মোহ অবস্থান থেকে সত্য কথা বলার সাহস দেখাতে পারতেন। জেল-জুলুম, অত্যাচার, নিপীড়ন এবং সরকারের অসহযোগিতাকে মোকাবিলা করে, নীতির প্রশ্নে অবিচল থেকে তাঁকে মানুষের অধিকারের কথা বলতে হয়েছে।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের কথা সহজ ভাষায় মানিক মিয়া মানুষের সামনে তুলে ধরতেন। তিনি ছিলেন নির্ভীক সাংবাদিকতার কিংবদন্তী পুরুষ, আধুনিক সংবাদপত্রের রূপকার, বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা। ‘রাজনৈতিক ধোঁকাবজি’, ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ আর ‘রঙ্গমঞ্চ’ শিরোনামে কলাম লিখে বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতাকামী করে তোলেন মানিক মিয়া। ‘মোসাফির’ শিরোনামে তাঁর ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ কলামে নির্ভীক সত্য ভাষণ, অনন্য রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনা এবং গণমানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণেই বাংলার মানুষের হূদয়ে তিনি অবিনশ্বর হয়ে রয়েছেন।
মানিক মিয়া প্রচলিত অর্থে শুধুমাত্র একজন সাংবাদিক ছিলেন না। বরং সাংবাদিকতার মাধ্যমে মানুষের মুক্তির পথ রচনার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তার আপসহীন মনোভাবের কারণে প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানি শাসকরা বার বার তাঁর কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে চেয়েছে। দৈনিক ইত্তেফাকের ওপর বার বার নেমে এসেছে বিপর্যয়। বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনে দৈনিক ইত্তেফাক এক অসামান্য ভূমিকা পালন করেছিল। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকে আপসহীনভাবে তিনি সত্য প্রকাশ করেছেন। একসময়ে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের সামরিক শাসক দৈনিক ইত্তেফাকের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। সে সময়ে সরকারের সঙ্গে আপস করলে তিনি ইত্তেফাক প্রকাশনা অব্যাহত রাখতে পারতেন। কিন্তু তিনি এবং তার চেতনায় উদ্বুদ্ধ সাংবাদিক শ্রেণি জনমানুষের সংবাদপত্রের প্রতি যে বিশ্বাস তার সঙ্গে আপস করেননি। তিন বছর পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ রেখেছিলেন। সামরিক জান্তা ও স্বৈরাচারী শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নির্ভীক সাংবাদিকতার যে উদাহরণ তিনি সৃষ্টি করে গেছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত।
কর্মসূচি: তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ইত্তেফাক গ্রুপের পক্ষ থেকে আজ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে: মরহুমের আজিমপুর কবরস্থানস্থ মাজারে সকাল ৭টা থেকে কোরানখানি, ১০টায় মোনাজাত ও তবারক বিতরণ, দৈনিক ইত্তেফাকের কাজলারপাড় কার্যালয় সংলগ্ন বায়তুল জান্নাত জামে মসজিদে বাদ জোহর মিলাদ মহফিল ও তবারক বিতরণ, মরহুমের কনিষ্ঠ পুত্র পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর ধানমন্ডির বাসভবনে সকালে কোরানখানি ও এতিমদের মধ্যে তবারক বিতরণ এবং মরহুমের জ্যেষ্ঠ কন্যা মরহুমা আক্তারুন্নাহার বেবী’র বাসভবনে বাদ এশা মিলাদ ও দোয়া মাহফিল।
এ উপলক্ষে জাতীয় পার্টি-জেপি বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে: সকাল ৮.৩০ মিনিটে মরহুমের মাজার জিয়ারত, পুস্পার্ঘ্য অর্পণ, ফাতিহা পাঠ ও সকাল ৯টায় মিলাদ মাহফিল। বিকাল ৩.৩০ মিনিটে রাজধানীর ডিপ্লোমা ইনজিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে মরহুমের কর্মময় জীবনের উপর আলোচনা সভা। এতে অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য বিষয়ক উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিষ্টার রফিক উল হক, ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম প্রমুখ।
এদিকে মানিক মিয়া রিসার্চ একাডেমি সকালে মরহুমের মাজারে পুস্পার্ঘ্য অর্পণ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে। বাংলাদেশ সাংবাদিক অধিকার ফোরাম সকাল ১১ টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে স্মরণসভার আয়োজন করেছে। এছাড়া পিরোজপুরে জেপির ভান্ডারিয়া শাখার উদ্যোগে স্থানীয় দলীয় কার্যালয়ে বাদ মাগরিব মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।