এ বি এন এ : ‘আয়নাবাজি’ ছবিটা কান চলচ্চিত্র উৎসব চলাকালীন দেখেছিলাম। গত মে মাসে এ আয়োজনের বাণিজ্যিক শাখা মার্শে দ্যু ফিল্মে অংশ নেয় এটি। উৎসবের মূলকেন্দ্র প্যালে ডি ফেস্টিভ্যাল ভবনের উল্টো দিকে গ্রে হোটেলের মিলনায়তনে এর প্রদর্শনীর আয়োজন করে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কন্টেন্ট ম্যাটারস লিমিটেড ও হাফ স্টপ ডাউন। কানসৈকতে বসে তখন বাংলাদেশি ছবি নিয়ে লেখার মতো উপলক্ষ্য পেয়ে আনন্দ হয়েছে।
‘আয়নাবাজি’ এবার ঢাকায় ব্লকবাস্টার সিনেমাসে গত ৩০ সেপ্টেম্বর মুক্তির প্রথম দিনেই সন্ধ্যায় দেখলাম। কানে ছবিটির যে সংস্করণ দেখেছি সেটার চেয়ে প্রেক্ষাগৃহে দৈর্ঘ্যটা বেশি। ব্যবধান প্রায় দ্বিগুণ। কারণ আন্তর্জাতিক উৎসবে দেড় ঘণ্টা বা এর কাছাকাছি সময়ের মধ্যে রাখতে হয় ছবির দৈর্ঘ্য। অবশ্য ‘আয়নাবাজি’কে দেড় ঘণ্টায় রেখে মুক্তি দিলে ক্ষতি যা হতো, প্রেক্ষাগৃহ পাওয়া যেতো না! কারণ সিনেমা হল মালিকরা দৈর্ঘ্য আড়াই-তিন ঘণ্টার কম হলে সেটাকে ছবি মনে করেন না! চালাতে অনীহা দেখান। এই বাস্তবতায় কোন নির্মাতাই বা ঝুঁকিতে যেতে চাইবেন।
কানের ‘আয়নাবাজি’ আর ঢাকার ‘আয়নাবাজি’র সময় কমবেশি হলেও গল্প কিন্তু উভয় সংস্করণেই পরিচালক অমিতাভ রেজা যথাযথভাবেই বলতে পেরেছেন। আয়না চরিত্রের মাধ্যমে দর্শককে তিনি নিয়ে গেছেন ভাবনার রঙিন এক দুনিয়ায়। যেখানে নিজেকে রাজা ভাবলেই মানুষ রাজা। ভিখারি ভাবলে ভিখারি। ছবিটি আগাগোড়াই মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলার।
গল্পটা শরাফত করিম আয়নার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে। অভিনয়ের স্কুল চালানো এই মানুষটা জাহাজে বাবুর্চির কাজ করার মিথ্যে বলে অপরাধীদের হয়ে জেল খাটেন। অন্য মানুষে রূপান্তর হয়ে সে মজা পায়। এটা দিনে দিনে তার নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মা যাত্রাদলে অভিনয় করতেন, পুত্রের মধ্যে তাই অভিনয়ের নেশা থাকা স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে মনের খোরাক পেতে গিয়ে ক্ষমতা আর টাকার জোরে অপরাধীদের পার পেয়ে যাওয়ার পথ তৈরি করে আয়নাও কিন্তু অপরাধী। এটা সে নিজেও জানে। তবু একজন অভিনেতা কেনো এই পথ বেছে নিলো তা বললে প্রেক্ষাগৃহে যাওয়ার মজা নষ্ট হবে!
আয়না চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী সম্ভবত জীবনের সেরা অভিনয়টা করে ফেলেছেন। ‘আয়নাবাজি’তে তিনি এমন চরিত্রকেও সাফল্যের সঙ্গে অনুকরণ করেছেন, তাকে দেখলে মনেই হয় না পারবেন! লুৎফর রহমান জর্জের বদলি অপরাধী হিসেবে তার দুর্দান্ত রসবোধপূর্ণ অভিনয় প্রত্যাশিতই ছিলো। তবে কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন তরুণের বদলি অপরাধী হওয়ার প্রস্তাব যখন আয়না পেলো, মনে হচ্ছিলো চঞ্চল হয়তো এটা অনুকরণ করতে পারবেন না। কিন্তু এখানে তিনি পুরোপুরি চমকে দিলেন। ছবি যতো এগোবে, তার অভিনয় দর্শককে ততো চমকাবে। অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করে দেবে। ‘আয়নাবাজি’ সত্যিকার অর্থেই অভিনয়ের ভাইরাস ছড়িয়ে দেয় দর্শকের মনে।
‘আয়নাবাজি’র চঞ্চলকে না দেখলে মিস করবেন! তাকে ছাড়া এই ছবি ভাবাই যায় না। পুরোটা দেখে মনে হলো, পৃথিবীর এহেন চরিত্র নেই যা ফুটিয়ে তুলতে পারবেন না তিনি। শুধু শুধু একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের নাটকে তাকে কাজ করিয়ে ছোটপর্দার দর্শককে একঘেঁয়েমি করা হয়েছে। ‘আয়নাবাজি’র মাধ্যমে চঞ্চল নির্মাতাদের পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দিলেন, তিনি পাকা অভিনেতা। কাদামাটির মতো। যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে তাকে গড়া যায়।
গল্পে ফিরে আসা যাক। আয়না সবার চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও হতাশাগ্রস্ত ক্রাইম রিপোর্টার সব বুঝে ফেলেন। তার সঙ্গে আয়নার লুকোচুরি আনন্দদায়ক। এ চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছেন গায়ক-নায়ক পার্থ বড়ুয়া। আয়না ও সাংবাদিকের দৃশ্যগুলোর পরিস্থিতি আপনাআপনি দর্শককে হাসায়। তবে হাসানোর লক্ষ্য নিয়েই সম্ভবত যুক্ত করা হয়েছে ‘মীরাক্কেল’ তারকা জামিলকে। সাংবাদিকের বাসায় থাকে সে। ভুল উচ্চারণে বরিশালের আঞ্চলিকতা নিয়ে ইংরেজি বলে। স্ত্রী (বিজরী বরকতুল্লাহ) ডিভোর্স দেওয়ায় এই তরুণের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল সাংবাদিক। তিনি পেছনে লেগে থাকেন বলে বাসা বদলায় আয়না।
আয়নার প্রেমিকা হৃদি তাকে সহযোগিতা করে। নতুন বাসায় ওঠার পর মেয়েটার চুম্বন বদলে দেয় তাকে। এ চরিত্রে মাসুমা রহমান নাবিলার অভিনয় ভালো লাগে। মনে হয়নি এটা তার অভিষেক ছবি। এই মেয়েটাকে ভালোবেসে অপরাধীদের বাঁচিয়ে অভিনয়ের ছলে অপরাধী হওয়ার কাজ ছেড়ে দেওয়ার মনস্থির করে আয়না। তারা সিলেটে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। কিন্তু সে সিলেটে গেলে ক্লাইম্যাক্সের কী হবে!
আয়না ধরা পড়ুক, দর্শকও তা চায় না। কিন্তু অপরাধ করলে একটা সময়ে ধরা সবাইকেই পড়তে হয়। আয়নাও ধরা পড়ে। তবে আইনের চোখে নয়, নিজের কাছে! গল্পের শেষে আয়না হুবহু তার মতো দেখতে রাজনীতিবিদ নিজাম চৌধুরীকে অনুকরণের কাজ পায়। কিন্তু সে করতে চায় না। বাধ্য হয়। আদর্শবান স্কুল শিক্ষককে খুনের দায়ে ফাঁসি হয় রাজনীতিবিদের। আয়নাকে বাঁচাতে আসে না আসল নিজাম। কিন্তু আয়না যে আসল রাজনীতিবিদ নয় তা কেবল জানেন সাংবাদিক। তিনি হৃদিকে জানান। জেলে আয়নার সঙ্গে দু’জনই দেখা করেন। আয়নার ফাঁসি হলো? যদি না হয় তাহলে সে জেল থেকে কীভাবে পালালো সেই পথটা শুরুর দিকে শিশুদেরকে আয়নার অভিনয় শেখানোর মাধ্যমে বলে দেওয়া হয়েছে। শুধু প্রেক্ষাগৃহে বসে মিলিয়ে নিতে হবে।
অমিতাভ রেজা এতোদিন বিজ্ঞাপন আর নাটক বানিয়েছেন, ‘আয়নাবাজি’তে চিরকুটের ‘না বুঝি দুনিয়া না বুঝি তোমায়’ গানে তার চিত্রায়ন দেখলে মনে হয়, তাকে দিয়ে মসলাদার বাণিজ্যিক ছবিও ভালোই হবে! তার ওপর আস্থা রেখে ভুল করেননি প্রযোজকরা। আগামীতেও বিফলে যাবে না তার ওপর বর্তানো দায়িত্ব, এটা বললে বেশি হবে না। বৃষ্টির দৃশ্যগুলো স্লো-মোশন করে দৃষ্টিনন্দন করেছেন তিনি। চিত্রগ্রহণে রাশেদ জামানের কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ছবিটির গল্পকার গাউসুল আলম শাওনকে অভিনন্দন। দারুণ একটা গল্প ভেবেছেন তিনি। একজন অভিনেতার অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা জানানোর পাশাপাশি এর পরতে পরতে বলা হয়েছে অপরাধীদের দুর্নীতি, নারীদের হয়রানিসহ সমাজের নানা অনিয়মের চিত্র। এজন্যই ‘আয়নাবাজি’কে কখনও মনে হয় সন্দেশ, কখনও গল্পটা মরিচ! অনম বিশ্বাসকে নিয়ে ছবিটির চিত্রনাট্য লিখেছেন গাউসুল আলম শাওন। স্টুডিও ব্যবসার নামে অপরাধ করে যাওয়া এক ব্যক্তির ভূমিকায় তার অভিনয়টা আনন্দ দেয়।
আনন্দদায়ক গানগুলোও। হাবিব ওয়াহিদ ও ন্যানসির গানটি শ্রুতিমধুর। অবশ্য ‘আলু পেয়াজের কাব্য’ গানে ইউটিউবে ভারতীয় গায়ক শানের কণ্ঠ শুনলে প্রেক্ষাগৃহে শোনা গেলো শায়ান চৌধুরী অর্ণব গাইছেন। এ ছাড়া ছবির শেষে ফুয়াদ আল মুকতাদিরের সুর-সংগীতে ‘লাগ ভেলকি লাগ’ দর্শককে টাইটেল দেখতেও উৎসাহিত করে।
শেষদিকে অতিথি শিল্পী হিসেবে আরিফিন শুভ মন কেড়েছেন। তিনি চোখের আরাম এনে দিয়েছেন বড়পর্দায়। কিছুদিন পর দীপংকর দীপনের ‘ঢাকা অ্যাটাক’ ছবিতে পুলিশের চরিত্রে যে তিনি দর্শক মাতাবেন, তারই একটা খসড়া যেন হয়ে গেলো ‘আয়নাবাজি’তে।
Chairman & Editor-in-Chief : Shaikh Saokat Ali,Managing Editor : Khondoker Niaz Ikbal,
Executive Editor : Mehedi Hasan,E-mail : abnanewsali@gmail.com
Usa Office: 2817 Fairmount, Avenue Atlantic city-08401,NJ, USA. Bangladesh Office : 15/9 Guptopara,Shemulbag,
2 nd floor,GS Tola, Teguriha, South Keraniganj, Dhaka.
Phone: +16094649559, Cell:+8801978-102344, +8801715-864295
Copyright © 2025 America Bangladesh News Agency. All rights reserved.