অর্থ বাণিজ্যবাংলাদেশলিড নিউজ

নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়বে : সিপিডি

এবিএনএ : ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের কর কাঠামো নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের ওপর নানাভাবে চাপ বাড়াবে বলে মনে করছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। এক কথায় নতুন অর্থবছরের বাজেটকে ‘নবীন বাংলাদেশের জন্য প্রবীণ বাজেট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে সংগঠনটি। সিপিডি বলছে, রাজস্ব আয় দুর্বল হয়ে পড়ছে। ভোগ ও আয় বৈষম্য বাড়ছে। এমন পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী যে বাজেট দিয়েছেন তাতে বিত্তবানদের খুশি রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। বিত্তবানদের বিভিন্নভাবে ছাড় দেয়া হলেও বাজেটে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ওপর করের বোঝা বাড়ানো হয়েছে।

বিনিয়োগ সমস্যার কথা উল্লেখ করে দেবপ্রিয় বলেন, আমাদের ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ এখনো স্থবির। যেটা স্বল্পমেয়াদি থেকে মধ্যমেয়াদি সমস্যায় পরিণত হয়েছে। একই সঙ্গে কর্মসংস্থার প্রবৃদ্ধির ও আয় বৃদ্ধির হার দুর্বল। মানবসম্পদের গুণগত মানও বেশ দুর্বল। সম্প্রতি দারিদ্র্য বিমোচনের হার ক্রমান্বয়ে কমছে। এর বড় কারণ হলো বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বৈষম্য ভোগের, আয়ের ও সম্পদের। উন্নয়নের সুযোগ-সুবিধা গরিব ও নিম্নমধ্যবিত্ত পাচ্ছে না, যার ফলে বৈষম্য বাড়ছে।

বৈষম্য বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, গত পাঁচ বছরে সব থকে কম আয়ের পাঁশ শতাংশ মানুষের ৬০ শতাংশের আয়ে ক্ষয় হয়েছে। আর সব থেকে বিত্তশালী পাঁচ শতাংশ থেকে ৫৭ দশমিক ৪ শতাংশের আয়ে বৃদ্ধি ঘটেছে। এখানে পুঁজি এবং সম্পদ যার আছে, তার আয় করার সুযোগ অনেক বেশি, যার শ্রম ও উদ্যোগ আছে তার তুলনায়। শ্রম ও উদ্যোগের তুলনায় পুঁজি ও সম্পদকে এই অর্থনীতি অনেক বেশি মূল্যায় করেছে। এটা মেধাভিত্তিক অর্থনীতির জন্য খুব ভালো খবর বলে আমাদের মনে হয় না। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন যে ধার-কর্য আছে তার ৬০ শতাংশের মতো অভ্যন্তরীণ উৎসের। এখন বাংলাদেশের দায় পরিশোধের বিষয়টি অনেক বেশি অভ্যন্তরীণ উৎসের ওপর আছে। আমাদের যে হারে ধার হচ্ছে, তাতে আমাদের টেকসই ঋণ নেয়ার যে ক্ষমতা তার ওপর চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে চাপ সৃষ্টির শঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা দেখেছি রফতানি ও রেমিটেন্স বাড়ার পরও বৈদশিক লেনদনের ক্ষেত্রে ঘাটতি বাড়ছে এবং সামগ্রীক বাণিজ্য ঘাটতিও বাড়ছে। এর ফলে অল্প অল্প করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষয় হচ্ছে, টাকার মূল্যমান কমছে। এর কারণ হলো এই অর্থবছরে ২৪ শতাংশ হারে আমাদের আমদানি বেড়েছে। আগামী অর্থবছরের জন্য ধরা হয়েছে ১২ শতাংশ। আমদানির যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছ, যে ধরনের বড় প্রকল্প হচ্ছে, তার সঙ্গে এই লক্ষ্যমাত্রা সামঞ্জস্যপূর্ণ না। আমরা মনে করি, আমদানি অনেক বাড়বে এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর যে চাপ তা অব্যহত থাকবে। রাজস্ব আদায়ের হার ব্যয় বৃদ্ধির হারের থেকে বেশি আছে উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, উন্নয়ন ব্যয় বৃদ্ধির হার স্লোথ রয়েছে। ফলে আমরা দেখছি আয় ও ব্যয় কম হওয়ার কারণে বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। এখন আগামী দিনে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার যে লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে, যা প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি। এই ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি আমরা মনে করি ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি। এটি একটি অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা।

‘এখানে লক্ষ্য করার বিষয়- বাড়তি যে লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে, তার বেশিরভাগ আসবে প্রত্যক্ষ কর থেকে। অর্থাৎ মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা তুলনামূলক বেশি পড়বে। বড় করদাতার খাত থেকে রাজস্ব আদায় বছর বছর বাড়ে, কিন্তু খুবই আশ্চর্যজনকভাবে এবার ২ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা কম হবে বলে আগে থেকেই প্রাক্কলন করা হয়েছে। আমাদের সন্দেহ হলো ব্যাংক খাতে যে রেয়াত দেয়া হয়েছে, তার একটি বড় প্রতিফল আমরা এখানে দেখতে পাচ্ছি,’- বলেন তিনি। বাজেট ঘাটতির অর্থ অভ্যন্তরীন উৎস থেকে নেয়াকে ‘শাখের করাত’ সমস্যা উল্লেখ করে সিপিডির এই বিশেষ ফেলো বলেন, আমরা একদিকে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেবো না, কারণ সুদের দায় বেড়ে যাচ্ছে। অপরদিকে ব্যাংক থেকে আপনি ঋণ নিতে গেলে তাদের (ব্যাংকের) তারল্য সংকট রয়েছে, ফলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। সার্বিকভাবে সঞ্চয়পত্র বনাম ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যা আগামী দিনে আছে বলে আমাদের মনে হয়। ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক খাতের কর্পোরেট কর হ্রাস করার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক খাতের আড়াই শতাংশ হারে কর্পোরেট হার কমানোর যে প্রস্তাব করা হয়েছে, আমরা তার বিরোধিতা করি। এই পদক্ষেপের কারণে সুদের হার কমবে বলে আমরা মনে করি না। ফলে এটি একটি ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত বলে আমরা ধারণা করছি।

কালো টাকা সাদা করার সুযোগ না দেয়ার দাবি জানিয় তিনি বলেন, আমরা নীতিগতভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার বিরোধিতা করি। বিভিন্ন সময় অর্থনীতিবিদরা স্বীকার করেছেন, জরিমানা দিয়ে মূল ধারায় কালো টাকা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দের বিষয়ে তিনি বলেন, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পতন ঘটেছে। সংশোধিত বাজেটে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ প্রায় ১২ শতাংশ ছিল, কিন্তু এখন ১১ দশমিক ৪ শতাংশের প্রস্তাব করা হয়েছে। শিক্ষাখাতের চেয়ে স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা আরও করুণ। দেবপ্রিয় বলেন, জবাবদিহির ক্ষেত্রেও সমস্যা রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী তিন মাস পরপর জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রীর মূল্যায়ন প্রতিবেদন দেয়ার কথা। সে হিসাবে মে মাস পর্যন্ত ওনার দেয়ার কথা ছিল ২৮টি রিপোর্ট। কিন্তু আমরা দেখছি ১৬টি রিপোর্ট। সুতরাং জাতীয় সংসদেও জবাবদিহির ক্ষেত্রটি খুব দুর্বল। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, খুবই নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সামাজিক সুরক্ষার আওতায় বিভিন্ন পদক্ষেপ আছে। সুতরাং তাদের ওপর করের যে চাপটা পড়বে তা কিছুটা সামলানো যেতে পারে। একই বিষয়ে দেবপ্রিয় বলেন, আমাদের রাজনৈতিক ব্যক্তিরা যত ভালো গরিব মানুষের প্রয়োজন অনুভব করেন ভোটের রাজনীতিতে, ভোটের অর্থের জন্য বিত্তবাদের প্রয়োজন অনুভব করেন, কণ্ঠস্বর না থাকার কারণে বিকাশমান মধ্যবিত্তদের তারা মূল্যায়ন করেন না। আরেক প্রশ্নের উত্তরে দেবপ্রিয় বলেন, আমাদের বড়বড় মেগা প্রকল্পের জন্য আমদানি হচ্ছে। একইসঙ্গে অর্থ পাচার হচ্ছে বলে আমাদের মনে হচ্ছে। এটা যদি বন্ধ না হয় আগামীতে টাকার মূল্য মান আরও কমবে এবং মূল্যস্ফীতিতে চাপ বাড়বে।

Share this content:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button