ধর্মলিড নিউজ

দুর্দিনে শ্রমিকের পাশে থাকার তাগিদ

মজুরি নিয়ে টালবাহানা অন্যায়

বেতন ও পারিশ্রমিক কর্মজীবীর অধিকার—ইসলাম দ্রুততম সময়ে তা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ঘাম শুকানোর আগেই শ্রমিকের পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৪৪৩০)। অন্য হাদিসে পারিশ্রমিক ও প্রাপ্য অধিকার নিয়ে টালবাহানাকে ‘অবিচার’ বলা হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘ধনী ব্যক্তির টালবাহানা অবিচার।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২২৮৭) অর্থাৎ সামর্থ্য থাকার পরও মানুষের প্রাপ্য ও অধিকার প্রদানে টালবাহানা করা অন্যায়। আর ঠুনকো অজুহাতে বেতন-ভাতা ও প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা আরো ভয়ংকর অপরাধ। মহানবী (সা.) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির বিপক্ষে থাকব।… আর একজন সে যে কাউকে শ্রমিক নিয়োগ দেওয়ার পর তা থেকে কাজ বুঝে নিয়েছে অথচ তার প্রাপ্য দেয়নি।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২২২৭)

করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা। হঠাৎ সৃষ্ট বেকারত্ব, কর্মস্থলের ছুটি ও অর্থনৈতিক মন্দা অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে তাদের। ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে খেটে খাওয়া মানুষের ভেতর। অর্থনৈতিক মন্দার পাশাপাশি তারা কর্তৃপক্ষের গাফলতিকেও দায়ী করছে। তাদের অভিযোগ সাধারণ ছুটি ঘোষণার কয়েক মাস আগের বেতন-ভাতাও বকেয়া রয়েছে এখনো। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাদের।

ইসলাম শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষের প্রাপ্য অধিকার প্রদানের কঠোর নির্দেশ দিয়েছে। এ ছাড়া দুর্যোগ ও দুর্দিনে তাদের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলেছে। প্রধানত এই দায়িত্ব নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের; এরপর রাষ্ট্র ও সমাজের। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইন উপেক্ষা করে শ্রমিকের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। তাদের ন্যায্য বেতন-ভাতা নিয়েও করা হচ্ছে টালবাহানা।

শ্রমিকরা মালিকের পরিবারভুক্ত

ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিক মালিকের পরিবারভুক্ত। ইসলাম শ্রমিককে ‘ভাই’ স্বীকৃতি দিয়ে তার জন্য মর্যাদাপূর্ণ জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করতে বলেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের দাসরা তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন করেছেন, কাজেই কারো ভাই যদি তার অধীনে থাকে তবে সে যা খায়, তা হতে যেন তাকে খেতে দেয় এবং সে যা পরিধান করে, তা হতে যেন পরিধান করায়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৫৪৫)

পবিত্র কোরআনে শ্রমিক-মালিক শ্রেণিবিন্যাস সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আমিই তাদের মধ্যে তাদের জীবিকা বণ্টন করি, পার্থিব জীবনে এবং একজনকে অপরের ওপর মর্যাদায় উন্নত করি, যাতে একে অপরের দ্বারা কাজ করিয়ে নিতে পারে। তারা যা জমা করে তা থেকে তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ উত্কৃষ্টতর।’ (সুরা জুখরুফ, আয়াত : ৩২)

শ্রমিকের জীবনজীবিকার নিরাপত্তা

শ্রমিকের মর্যাদাপূর্ণ জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব মালিকেরই। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মালিকানাধীন (অধীন) ব্যক্তির জন্য খাবার ও কাপড়ের অধিকার রয়েছে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৬৬২)

অন্য হাদিসে তিনি বলেছেন, ‘যে আমাদের কর্মী নিযুক্ত হয়েছে সে যেন (প্রতিষ্ঠানের খরচে) একজন স্ত্রী সংগ্রহ করে, সেবক না থাকলে সে যেন একজন সেবক সংগ্রহ করে এবং বাসস্থান না থাকলে সে যেন একটি বাসস্থান সংগ্রহ করে। যে ব্যক্তি এর অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করবে সে প্রতারক বা চোর গণ্য হবে।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ২৯৪৫)

দুর্দিনে শ্রমিকের পাশে থাকার তাগিদ

ইসলাম সাধারণভাবেই দুর্দিনে অভাবগ্রস্ত ও অসহায় মানুষের পাশে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। আর অসহায় ও অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি যদি হয় তার সেবা দানকারী শ্রমিক—তবে এই দায়িত্ব বেড়ে যায় বহুগুণ। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) মালিকপক্ষকে শ্রমিকের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করার তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সে যা খায়, তা হতে যেন তাকে খেতে দেয় এবং সে যা পরিধান করে, তা হতে যেন পরিধান করায়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৫৪৫)

ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, ‘যৌবনকালে যে ব্যক্তি শ্রম দিয়ে রাষ্ট্র ও জনগণের সেবা করেছে, বৃদ্ধকালে রাষ্ট্র (কর্তৃপক্ষ) তার হাতে ভিক্ষার ঝুলি তুলে দিতে পারে না।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)

এসব বক্তব্য থেকে দুর্দিনে শ্রমিকের পাশে থাকার গুরুত্ব বোঝা যায়। এ ছাড়া পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত থেকেও প্রয়োজনের সময় অধীনদের জীবনোপকরণের ব্যবস্থা করার নির্দেশনা পাওয়া যায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা জীবনোপকরণে তোমাদের কাউকে কারো ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। যাদের শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে তারা তাদের অধীন দাস-দাসীদের নিজেদের জীবনোপকরণ থেকে এমন কিছু দেয় না, যাতে তারা তাদের সমান হয়ে যায়। তবে কি তারা আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করে?’ (সুরা নাহল, আয়াত : ৭১)

অসহায় শ্রমিক  রাষ্ট্রের দায়িত্ব

জাতীয় দুর্যোগের সময় নিম্ন আয়ের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সম্পদের সুষম বণ্টন ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থায় নেবে ইসলামী রাষ্ট্র। প্রখ্যাত তায়েবি আবু মুসলিম খাওলানি (রহ.) ও মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান (রা.)-এর মধ্যকার কথোপকথন থেকে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। তিনি মুয়াবিয়া (রা.)-কে বলেন, ‘(রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী হিসেবে) আপনার দৃষ্টান্ত হলো সেই ব্যক্তির মতো—যে একজন শ্রমিক নিয়োগ দিল এবং তার পশুপাল তার হাতে অর্পণ করল। যেন সে তা যথাযথভাবে দেখভাল করে এবং তার পশম ও দুধ সংগ্রহ করে। যদি সে উত্তম দেখভাল করে—ফলে পশুপালের ছোট পশু বড় হয় এবং দুর্বলগুলো সবল হয়, তবে সে মজুরির উপযুক্ত হয়; কখনো বেশি পায়। আর যদি সে ঠিকভাবে দেখাশোনা না করে; বরং তা ধ্বংসের পথ উন্মুক্ত করে—ফলে পালের দুর্বল পশু ধ্বংস হয়ে যায়, শক্তিশালীগুলো দুর্বল হয়ে যায় এবং সে পশুর পশম ও দুধও ঠিকমতো সংগ্রহ না করে, তবে মালিক তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়, তাকে মজুরি দেয় না; বরং তাকে শাস্তি প্রদান করে।’ (আল্লামা ইবনে আসাকির (রহ.), তারিখু দামিস্ক : ২৭/২২৩)

রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা  প্রশাসনের দায়িত্ব

গণমাধ্যমে সরকারি ত্রাণ ও প্রণোদনা সামগ্রী নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারি ত্রাণ ও প্রণোদনার অর্থ যথাযথ মানুষের হাতে পৌঁছে দেওয়া প্রশাসনের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালন করলে সে আল্লাহর দরবারে একজন দাতা হিসেবে গণ্য হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘বিশ্বস্ত খাজাঞ্চি—যাকে কোনো কিছু নির্দেশ করলে সন্তুষ্টচিত্তে তা আদায় করে, সে দাতাদের একজন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২২৬০)

শ্রমিক ঠকানোর ভয়াবহ পরিণতি

শ্রমিক ঠকানো ইসলামের দৃষ্টি জঘন্যতম পাপ; বরং ইসলামের নির্দেশনা হলো, শ্রমিক তার প্রাপ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না হলেও মালিক তাকে প্রাপ্য বুঝিয়ে দেবে। যেমনটি শোআইব (আ.) মুসা (আ.)-কে ডেকে এনে পারিশ্রমিক দিয়েছিলেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তখন নারীদ্বয়ের একজন সলজ্জ পায়ে তার কাছে এলো এবং বলল, আমার পিতা আপনাকে আমন্ত্রণ করেছেন আমাদের পশুগুলোকে পানি পান করানোর বিনিময় প্রদানের জন্য।’ (সুরা কাসাস, আয়াত : ২৫)। অথচ বর্তমানে অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করতে হয়। মহানবী (সা.) এই ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘যে জাতির দুর্বল লোকেরা জোর-জবরদস্তি ছাড়া তাদের পাওনা আদায় করতে পারে না সেই জাতি কখনো পবিত্র হতে পারে না।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৪২৬)

অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর কাছে জঘন্যতম পাপী হলো—যে ব্যক্তি কোনো নারীকে বিয়ে করল। অতঃপর প্রয়োজন পূরণ হওয়ার পর সে তাকে তালাক দেয় এবং তাকে মোহর থেকে বঞ্চিত করে; যে ব্যক্তি কারো কাছ থেকে শ্রম আদায় করল এবং তার পারিশ্রমিক না দিয়ে চলে গেল; অপরজন হলো যে অনর্থক কোনো প্রাণী হত্যা করে।’ (মুসতাদরাকুল হাকিম, হাদিস : ২৭৪৩)

Share this content:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button