লাইফ স্টাইললিড নিউজ

ঢাকার দুই সিটিতে আ.লীগের ১১২ বিদ্রোহী প্রার্থী

এবিএনএ : ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ১২৯ ওয়ার্ডের মধ্যে ৭৭টিতেই আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের স্বদলীয় ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এসব ওয়ার্ডে ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহী প্রার্থী ১১২ জন, যাঁদের মধ্যে এক সাংসদের ছেলেও আছেন। এ ছাড়া ১০ জন বর্তমান কাউন্সিলর বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন।

মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটির (ডিএসসিসি) ৭৫টি সাধারণ ওয়ার্ডের মধ্যে ৪২টিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আছেন ৭২ জন। আর ঢাকা উত্তর সিটিতে (ডিএনসিসি) ওয়ার্ড ৫৪টি। এর মধ্যে ৩৫টিতে ৪০ জন বিদ্রোহী প্রার্থী আছেন। সবাই নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে মাঠে প্রচার-জনসংযোগ করছেন।

বিদ্রোহী প্রার্থীদের এই ছড়াছড়ির মধ্যেও দক্ষিণের দুটি সাধারণ (২৫ ও ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড) ও দুটি সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ৩০ জানুয়ারি ঢাকার দুই সিটিতে ভোট হবে। দুটিতেই ইভিএমে (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ভোট গ্রহণ করা হবে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় প্রতীকে ভোট হলেও ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ডে মহিলা কাউন্সিলর পদে ভোট হয় নির্দলীয়ভাবে। যদিও ঢাকার দুই সিটিতে কাউন্সিলর পদেও প্রার্থীদের দলগত সমর্থন দিয়ে আসছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।

বিদ্রোহী ১১ কাউন্সিলর
গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন এমন ৩৬ জন এবার দলীয় সমর্থন পাননি। তাঁদের মধ্যে উত্তরে চারজন ও দক্ষিণে সাতজন দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে প্রার্থী হয়েছেন।

উত্তরের বিদ্রোহীদের মধ্যে রয়েছেন ৪ নম্বর ওয়ার্ডে জহিরুল ইসলাম। সেখানে দল থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন পল্লবী থানার সহসভাপতি জিন্নাত আলী মাদবর। ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সহসভাপতি হুমায়ুন রশিদ। সেখানে দলীয় প্রার্থী হলেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মইজ উদ্দিন।

৪১ নম্বর ওয়ার্ডে দলের সমর্থন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের সাতারকুল ইউনিয়নের সভাপতি আবদুল মতিন। এই ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর শফিকুল ইসলামও নির্বাচনী মাঠে আছেন। তিনি দলের সমর্থন পেয়েছেন বলে দাবি করছেন।

৪৯ নম্বর ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর আনিছুর রহমান ওরফে নাঈম বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন। সেখানে দলীয় সমর্থন পান দক্ষিণখান ইউনিয়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক সফিউদ্দিন মোল্লা।

ঢাকা দক্ষিণের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মুন্সী কামরুজ্জামান, ২২ নম্বর ওয়ার্ডের তারিকুল ইসলাম, ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের বিল্লাল শাহ, ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের ময়নুল হক ওরফে মঞ্জু, ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের দেলোয়ার হোসেন খান, ৭৪ নম্বর ওয়ার্ডের আবুল কালাম আজাদ এবং ৯ নম্বর ওয়ার্ডে বহিষ্কৃত কাউন্সিলর মমিনুল হক ওরফে সাঈদ। তাঁদের মধ্যে চাঁদাবাজির মামলায় কারাগারে আছেন ময়নুল হক।

১৯ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর মুন্সী কামরুজ্জামান বলেন, ‘২০১৫ সালে দলীয় সমর্থন পেয়ে নির্বাচন করেছি। এবার প্রথমে দল সমর্থন দেয়নি। তবে গত বৃহস্পতিবার দলের উচ্চপর্যায় থেকে নির্বাচন করার জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছে।’

২২ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর তারিকুল ইসলাম দলের এই ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক। তিনি ২০১৫ সালে দলের সমর্থন না পেয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছেন। এবারও তিনি বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন এবং জয়ের ব্যাপারে আশা প্রকাশ করেছেন।

৩২ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর বিল্লাল শাহ। তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদের কোতোয়ালি থানা কমিটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি। তবে এই ওয়ার্ডে এবার দলের সমর্থন পেয়েছেন আবদুল মান্নান।

দক্ষিণের বিদ্রোহী
২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও দক্ষিণ সিটির প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। এবারও ৩৪টি সাধারণ ওয়ার্ডে বিদ্রোহী প্রার্থীর খোঁজ পাওয়া গেছে।

দক্ষিণের ১ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছেন খিলগাঁও থানা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম। তাঁর বিপরীতে মাঠে রয়েছেন যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহসম্পাদক শাহাদাত হোসেন।

 ৮ নম্বর ওয়ার্ডে প্রথমে দলের সমর্থন পেয়েছিলেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা ইসমাইল জবিউল্লাহ। পরে তাঁকে বাদ দিয়ে বর্তমান কাউন্সিলর সুলতান মিয়াকে প্রার্থী ঘোষণা করে দল। সুলতান মিয়া বলেন, দল ইসমাইল জবিউল্লার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে বলেছে। কিন্তু তিনি এখনো মাঠ ছাড়েননি।

২৪ নম্বর ওয়ার্ডে দলীয় প্রার্থী বর্তমান কাউন্সিলর মোকাদ্দেস হোসেন। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের লালবাগ থানার সাবেক সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন। তিনি এর আগে দুবার এই ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করে হেরেছেন।

২৭ নম্বর ওয়ার্ডে দলের প্রার্থী বর্তমান কাউন্সিলর ওমর-বিন-আব্দাল আজিজ। তবে এই ওয়ার্ডে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সাবেক সহসম্পাদক সাগর আহমেদ। তিনি বলেন, ‘দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সমর্থন নিয়েই নির্বাচন করছি। আমার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের জন্য দল থেকে কেউ কিছু বলেনি।’

২৮ নম্বর ওয়ার্ডে দলের সমর্থন পেয়েছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. সালেহিন। বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে আছেন দলের লালবাগ থানার সাবেক নেতা কামাল উদ্দিন (কাবুল)। তিনি এর আগেও বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করে হেরেছেন।

৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে দলীয় প্রার্থী বর্তমান কাউন্সিলর রঞ্জন বিশ্বাসের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক সমিন রায় ও সদস্য বাবুল দাস। তাঁরাও নিজ এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন।

৪৮ নম্বর ওয়ার্ডে দলীয় প্রার্থী আবুল কালামের বিপরীতে প্রার্থী হয়েছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ কে এম ফজলুল হক।

উত্তরের বিদ্রোহী
উত্তর সিটির ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে দলের সমর্থন পান ভাটারা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইসহাক মিয়া। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে আছেন ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরীফুল ইসলাম।

৪ নম্বর ওয়ার্ডে দলীয় সমর্থন না পেয়েও প্রার্থী হয়েছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন। এই ওয়ার্ডে দলীয় সমর্থন পেয়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর জামাল মোস্তফা।

৬ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন তাইজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।

১১ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ থেকে সমর্থন পেয়েছেন বর্তমান ওয়ার্ড কাউন্সিলর দেওয়ান আবদুল মান্নান। এই ওয়ার্ডে দলের দুজন বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। তাঁরা হলেন মিরপুর থানা সাংগঠনিক সম্পাদক মনসুর আলী ও সহসভাপতি গাজী আলিয়ার রহমান।

২০ নম্বর ওয়ার্ডে প্রথম দলের সমর্থন পেয়েছিলেন জাহিদুর রহমান। তিনি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। কিছুদিন পর এই ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর মো. নাছিরকে সমর্থন দেয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু নির্বাচনী মাঠ ছাড়েননি জাহিদুর রহমান।

 ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হলেন তেজগাঁও থানা কমিটির সহসভাপতি আবদুল্লাহ আল মঞ্জুর। এই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী দুজন। তাঁর হলেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মীর আশরাফ উদ্দিন খান ও সাংগঠনিক সম্পাদক মোকছেদ আলী মোল্লা।

মোকছেদ আলী মোল্লা বলেন, ‘দলের সমর্থন চেয়ে আবেদন করেছিলাম, পাইনি। পরে তৃণমূলের সমর্থন নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছি।’

২৬ নম্বর ওয়ার্ডে দলীয় প্রার্থী হলেন বর্তমান কাউন্সিলর শামীম হাসান। তিনি দলের তেজগাঁও থানার সাধারণ সম্পাদক। বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচনী মাঠে আছেন ওয়ার্ডের সদস্য মাসুদ রানা। শামীম হাসান বলেন, ‘মাসুদ রানাকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে চিঠি দিয়েছিল মহানগর কমিটি। কিন্তু তা তিনি আমলে নেননি।’

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি দেওয়ার পরও এসব বিদ্রোহী প্রার্থীর অনেকে শক্তভাবেই মাঠে আছেন বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। দলের অন্যদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেব।’ তবে ঠিক কবে এবং কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা স্পষ্ট করে বলেননি তিনি।

এর আগে বিভিন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দেখা গেছে, কাউন্সিলর পদে দলীয় প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে মারামারি ও সংঘর্ষ হয়েছে। এ কারণে যেখানে সরকারি দলের বিদ্রোহী প্রার্থী থাকেন, সেখানে আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কা বেশি থাকে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে উন্মুক্ত নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু এখন পদটিতে দলীয় প্রার্থী সমর্থন দিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। ফলে ভোটাররা পছন্দের প্রার্থী যাচাইয়ে সুযোগ কম পাচ্ছেন। তিনি বলেন, দলীয় প্রার্থী বা বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে অনেক সময় মারামারি হয়। এতে ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করে। নিরাপত্তার কথা ভেবে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যান না। তাই কাউন্সিলর পদে দলীয় প্রার্থী সমর্থনের সিদ্ধান্ত থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সরে আসতে হবে।

Share this content:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button