জাতীয়বাংলাদেশলিড নিউজ

উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের স্বীকৃতি পেল বাংলাদেশ

এবিএনএ : প্রথমবারের মতো স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি)  ক্যাটাগরি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করল বাংলাদেশ।জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিপিডি) এই ঘোষণাসংক্রান্ত চিঠি শুক্রবার জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেনের কাছে হস্তান্তর করেছে। বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনে বিকেলে আয়োজিত এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূত মাসুদের কাছে এই চিঠি হস্তান্তর করেন সিপিডি সেক্রেটারিয়েটের প্রধান রোলান্ড মোলেরাস।
শনিবার জাতিসংঘ স্থায়ী মিশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়, ১৬ মার্চ সিপিডি জাতিসংঘ সদরদপ্তরে এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনসংক্রান্ত ঘোষণা দেয়। সে অনুযায়ী এই চিঠি হস্তান্তর করা হলো।
বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি আগেই পেয়েছিল। এবার জাতিসংঘের ঘোষণা এল এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের।
স্থায়ী মিশনে আয়োজিত অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সিপিডি এক্সপার্ট গ্রুপের চেয়ার প্রফেসর হোসে অ্যান্তোনিও ওকাম্পো, জাতিসংঘের এলডিসি, এলএলডিসি (ভূ-বেষ্টিত উন্নয়নশীল দেশ) ও সিডস (উন্নয়নশীল ক্ষুদ্র দ্বীপ-রাষ্ট্রসমূহ) সংক্রান্ত কার্যালয়ের উচ্চতম প্রতিনিধি আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ফেকিতামইলোয়া কাতোয়া উটইকামানু, জাতিসংঘে নিযুক্ত বেলজিয়ামের স্থায়ী প্রতিনিধি মার্ক পিস্টিন, তুরস্কের স্থায়ী প্রতিনিধি ফেরিদূন হাদী সিনিরলিওলু, ইউএনডিপির এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের আঞ্চলিক ব্যুরোর পরিচালক ও জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হাওলিয়াং ঝু এবং ইউএনডিপির মানবিক উন্নয়ন রিপোর্ট অফিসের পরিচালক ড. সেলিম জাহান।
এ ছাড়া বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন ও নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের কর্মকর্তারা এবং জাতিসংঘ সদরদপ্তরে কর্মরত বাংলাদেশের কর্মকর্তারাও এ সময় উপস্থিত ছিলেন। কতিপয় এলডিসি দেশের প্রতিনিধি এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন এজেন্সির কর্মকর্তারা অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার ওপর একটি ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করা হয়। ভিডিও চিত্রে উঠে আসে স্বাধীনতা অর্জনের পর ৫০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে কীভাবে বাংলাদেশ দ্রুতগতিসম্পন্ন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মতো সফলতা দেখাতে যাচ্ছে। উঠে আসে জাতির পিতা কীভাবে সমগ্র জাতিকে স্বাধীনতার জন্য একতাবদ্ধ করেছিলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ থেকে কীভাবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত হতে যাচ্ছে- সেসব উন্নয়ন পরিক্রমা।
একে একে তুলে ধরা হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্ব, দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্র্য সীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমূখি শিল্পায়ন, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পোশাক শিল্প, ওষুধ শিল্প, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক।
উপস্থিত সুধীজনের উদ্দেশে প্রদত্ত বক্তৃতায় স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘আমাদের সকলের জন্য আজ এক ঐতিহাসিক দিন। অত্যন্ত আনন্দের সাথে আপনাদের জানাচ্ছি যে বাংলাদেশ এই প্রথম এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের সকল নির্ণায়ক পূর্ণ করেছে।’
উল্লেখ্য, এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক এ তিনটির যেকোনো দুটি অর্জনের শর্ত থাকলেও বাংলাদেশ এ তিনটি সূচকের মানদণ্ডেই উন্নীত হয়েছে।
জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল (ইকোসক) এর মানদণ্ড অনুযায়ী এক্ষেত্রে এ বছরে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হবে কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় তার থেকে অনেক বেশি অর্থাৎ ১৬১০ মার্কিন ডলার। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৭২.৯। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক হতে হবে ৩২ ভাগ বা এর কম যেখানে বাংলাদেশের রয়েছে ২৪ দশমিক ৮ ভাগ।
‘যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এই উত্তরণ- যেখানে রয়েছে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার ইতিহাস’ উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাহসী এবং অগ্রগতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কাঠামোগত রূপান্তর ও উল্লেখযোগ্য সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে আমাদের দ্রুত উন্নয়নের পথে নিয়ে এসেছে।’
স্বল্পোন্নত দেশসমূহের জন্য ইস্তাম্বুল ঘোষণার কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত আরো বলেন, ‘২০২০ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশসমূহের অর্ধেক এই ক্যাটাগরি থেকে উত্তীর্ণ হবে এটিই ছিল ইস্তাম্বুল ঘোষণার একটি প্রধানতম উদ্দেশ্য যা এজেন্ডা ২০৩০ বাস্তবায়ন অর্থাৎ দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ও সমৃদ্ধি বিনির্মাণের পরিপূরকও বটে।’ রাষ্ট্রদূত তার বক্তৃতায় আরো উল্লেখ করেন, ‘কেউ পেছনে পড়ে থাকবে না -এই প্রতিশ্রুতি ধারণ করে আমরা শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছি। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ -আমাদের জন্য শুধু একটি স্লোগানই নয়, সারা দেশের মানুষ আজ এর সুবিধা পাচ্ছেন। প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা ও জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আজ আমাদের হাতিয়ার।’
বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মর্মে রাষ্ট্রদূত মাসুদ উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের দেশকে উন্নয়নের ক্ষেত্রে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই যা আমাদের দীর্ঘদিনের লালিত আকাঙ্খা। আজ বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭.২৮ শতাংশ। আমরা এসডিজির সাথে আমাদের জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনাকে একীভূত করেছি। এসডিজি বাস্তবায়নেও আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের এলডিসি থেকে উত্তরণ এ সকল দর্শনের সাথে একই সূত্রে গাঁথা।’
এলডিসি ক্যাটাগরির দেশসমূহের এই উত্তরণ প্রক্রিয়া জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত সাফল্যের স্বাক্ষর বহণ করছে মর্মে তিনি উল্লেখ করেন। বাংলাদেশকে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় সহযোগিতার জন্য তিনি জাতিসংঘসহ বাংলাদেশের সকল উন্নয়ন সহযোগীদের ধন্যবাদ জানান। তিনি আশা প্রকাশ করেন, উত্তরণকে টেকসই করতে এবং এজেন্ডা ২০৩০ বাস্তবায়নে এই সহযোগিতার ধারা অব্যাহত থাকবে। উত্তরণ প্রক্রিয়ায় থাকা স্বল্পোন্নত দেশসমূহের সাথে বাংলাদেশ তার অভিজ্ঞতা ও সর্বোত্তম কর্মপন্থা ভাগ করে নিতে সদা প্রস্তুত রয়েছে মর্মে স্থায়ী প্রতিনিধি জানান।
চিঠি হস্তান্তরের পর সিপিডি সেক্রেটারিয়েটের প্রধান রোলান্ড মোলেরাস তার বক্তব্যে বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের কাঙ্খিত বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ সামাজিক খাতগুলোর ব্যাপক উন্নয়ন এই উত্তরণের ক্ষেত্রে কমিটির সুপারিশ প্রদানকে সহজতর করেছে মর্মে উল্লেখ করেন। সিপিডি এক্সপার্ট গ্রুপের চেয়ার প্রফেসর হোসে অ্যান্তোনিও ওকাম্পো বাংলাদেশের সাফল্যমণ্ডিত উন্নয়নের ইতিহাস রয়েছে বলে অভিমত প্রকাশ করেন। তিনি বাংলাদেশের গতিশীল রপ্তানি খাত, মানবিক সম্পদ এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের ব্যাপক উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
জাতিসংঘের এলডিসি, এলএলডিসি ও সিডস সংক্রান্ত কার্যালয়ের উচ্চতম প্রতিনিধি আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল উটইকামানু বলেন, ‘দ্রারিদ্র্য হ্রাস ও উন্নয়নের অগ্রগতির জন্য বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি হয়েছে। ১৪% এর নিচে নেমে এসেছে অতি দারিদ্র্য সীমা। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেক বছর ধরে স্থিতিশীল রয়েছে। রূপকল্প ২০২১ নিরবচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রাধিকারসমূহকে পরিচালিত করে যাচ্ছে।’ এ ছাড়া বক্তব্য রাখেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বেলজিয়ামের স্থায়ী প্রতিনিধি মার্ক পিস্টিন, তুরস্কের স্থায়ী প্রতিনিধি সিনিরলিওলু, ইউএনডিপির এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের আঞ্চলিক ব্যুরোর পরিচালক ও জাসিংঘের সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল হাওলিয়াং ঝু। সকল বক্তাই এই অর্জনে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারকে অভিনন্দন জানান এবং এই অর্জনের পেছনে বাংলাদেশের বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ধারাবাহিক অগ্রগতির কথা উল্লেখ করেন। বক্তারা এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে সদ্য উর্ত্তীণ দেশগুলোকে তাদের টেকসই উত্তরণ টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান।

Share this content:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button