জাতীয়বাংলাদেশলিড নিউজ

বায়োমেট্রিকে সিম পুনঃনিবন্ধন: সার্ভার ডাউন, অবৈধভাবে টাকা আদায়

বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম পুনর্নিবন্ধন করতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন গ্রাহকরা। গতকাল শুক্রবার বন্ধের দিনও সকাল থেকে মোবাইল অপারেটরদের কাস্টমার সার্ভিস ও রিটেলার পয়েন্টে গ্রাহকদের দীর্ঘ লাইন ছিল। এর মধ্যে সকাল থেকে সার্ভার ডাউন হয়ে যায়। অপারেটরা বলছে, এনআইডির সার্ভার ডাউন হওয়ার কারণে এক একটি নিবন্ধনের কাজ শেষ করতে দীর্ঘ সময় লাগছে। অন্যদিকে এনআইডি কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের সার্ভারে কোনো সমস্যা নেই।

টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী নিজে বসে থেকে সেটা দেখেছেন। সরকারের তরফ থেকে সময় না বাড়ানো ইঙ্গিত দেয়ার কারণে আজ শনিবারই শেষ হচ্ছে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধনের কাজ। এই ভোগান্তির মধ্যেই আবার যোগ হয়েছে রিটেলারদের অবৈধভাবে টাকা আদায়। অনেক জায়গায় ৫০-১০০ টাকা রেট নির্ধারণ করে আদায় করা হচ্ছে। এ নিয়ে গ্রাহকদের নিবন্ধনকারীদের তর্কাতর্কি- এমনকি হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। বাধ্য হয়েই গ্রাহকরা টাকা দিয়েই কাজ শেষ করছেন।

টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেন, ‘টাকা আদায়ের ব্যাপারে আমরা কঠোর নির্দেশনা দিয়েছি। তারপরও এটা হয়েছে। আমি নিজে একজনকে পুলিশে দিয়েছি। আর সার্ভার ডাউনের বিষয়ে আমি বলব, এনআইডির তরফে কোনো সমস্যা ছিল না। আমি নিজে আড়াই ঘণ্টা সেখানে বসে তাদের কাজ দেখেছি। আমার সঙ্গে মোবাইল অপারেটরদের টেকনিক্যাল এক্সপার্টরাও ছিলেন। তারা কিন্তু কোনো ফলট খুঁজে পাননি। আসলে যার সমস্যাই হোক না কেন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার মধ্যে সেটা শেষ হয়ে গেছে। কাল (আজ শনিবার) আমি দেখব শেষ মুহূর্তে কত রেজিস্ট্রেশন হয়, এরপর সময় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানাব। সময় বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, আসলে এটা তো অনির্দিষ্টকাল ধরে চলতে পারে না। এর একটা নির্দিষ্ট সময় থাকা উচিত। তবে গ্রাহকদের কথা চিন্তা করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাব। প্রতিটি মানুষই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

শুক্রবার সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কাস্টমার সেন্টার, রিটেলার পয়েন্ট ও রাস্তার মধ্যে ছাতা টাঙিয়ে বসে সিম নিবন্ধনের কাজ হচ্ছে। এসব জায়গায় গ্রাহকদের দীর্ঘ লাইন। গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রি-পেইড ও পোস্ট পেইড এর জন্য আলাদাভাবে টাকা আদায় করা হচ্ছে। মোহাম্মদপুরের শেখেরটেকের ১২ নম্বর রোডে ছাতা টাঙিয়ে নিবন্ধন করার সময় কথা বলতে গেলে তারা জানালেন, প্রি-পেইডে খুশি হয়ে যা দিচ্ছে তাই নিচ্ছি। কিন্তু পোস্ট পেইডে ৫০ টাকা না হলে করা যাবে না। আবার মোহাম্মদপুর নূর জাহান রোডে পোস্ট পেইড একশ’ টাকা করে নিচ্ছে। এ নিয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে তর্কাতর্কি এমনকি হাতাহাতিও হয়েছে।

ধানমন্ডির বাসিন্দা আফিজুর রহমান বললেন, ‘আমি একটি ব্যাংকে চাকরি করি। এতদিন সময় না পাওয়ায় শুক্রবার ছুটির দিনে এসেছি। নিবন্ধন শেষ হতে অনেক সময় লেগেছে। এই কেন্দ্রে অনেক লম্বা লাইন ছিল। তারপর সার্ভার ডাউনের কারণে তথ্য নাকি মেলানো যাচ্ছিল না। কয়েকবার পিন কোড দেয়ার পর নিবন্ধন শেষ হয়েছে।’ শুধু এই গ্রাহকই নয়, গতকাল যারা সিম নিবন্ধন করতে গেছেন তাদের সবাইকে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে দীর্ঘ সময় বসে থাকতে হয়েছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে যে কাজ হওয়ার কথা সেটা করতে অনেক সময় ঘণ্টাও লেগে গেছে।

জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অণুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সুলতানুজ্জামান মো. সালেহউদ্দিন ইত্তেফাককে বলেন, ‘আজ (গতকাল) বিকেল সাড়ে ৩টায় প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম আমাদের সার্ভার রুমে এসেছিলেন। পৌনে ৫টা পর্যন্ত তিনি এখানে ছিলেন। প্রতিমন্ত্রী অপারেটরদের টেকনিক্যাল এক্সপার্ট নিয়ে এসেছিলেন। আমাদের টেকনিক্যাল এক্সপার্টরাও ছিলেন। প্রতিমন্ত্রী চলে যাওয়ার পরও তারা বসে আছেন। কিন্তু তারা এনআইডির কোনো ত্রুটি খুঁজে পাননি।’ তিনি বলেন, ‘প্রতিমন্ত্রীকে আমরা দেখিয়েছি প্রতি সেকেন্ডে ৬ হাজার ডাটা নিতে সক্ষম আমাদের সার্ভার। কিন্তু মোবাইল অপারেটররা সর্বোচ্চ সেকেন্ডে ৩২৫ টা ডাটা পাঠাতে পারছে। তাহলে সমস্যাটা কার? বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রযুক্তি দিয়ে এই সার্ভার করা হয়েছে। এখানে কোনো সমস্যাই নেই।’

মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অফ মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের (অ্যামটব) মহাসচিব টি আই এম নুরুল কবির ইত্তেফাককে বলেন, ‘নিবন্ধনের অতিরিক্ত চাপে সার্ভারে সমস্যা হতে পারে। অপারেটর ও এনআইডি কর্তৃপক্ষের কারিগরি দল এ সমস্যা সমাধানে কাজ করে যাচ্ছে। গ্রামীণফোনের হেড অব কর্পোরেট এ্যাফেয়ার্স মাহমুদ হোসাইন ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। গ্রাহকদের চাপের কারণে অনেক ক্ষেত্রে সমস্যা হয়েছে।’ রবির ভাইস প্রেসিডেন্ট ইকরাম কবির ইত্তেফাককে বলেন, ‘অত্যাধিক চাপের কারণে সার্ভার স্লো হয়ে গেছে। তারপরও গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সাড়ে ৩ লাখ গ্রাহক রবির নিবন্ধন করেছেন। গত দুই দিনে সাড়ে ৭ লাখের বেশি নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে।’

গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সারাদেশে আট কোটি ৩৮ লাখ সিম পুনর্নিবন্ধনের কাজ শেষ হয়েছে। মোবাইল অপারেটররা জানিয়েছে, এ পর্যন্ত সারাদেশে মোট সিম বিক্রি করা হয়েছে প্রায় ১৩ কোটি ১০ লাখ। অর্থাত্ এখনো প্রায় ৫ কোটি সিমের নিবন্ধন বাকি আছে। আজ শনিবার সময় বাড়ানো না হলে রাত ১০টা পর্যন্ত সিম নিবন্ধন করা যাবে। যেসব সিম নিবন্ধন হবে না সেগুলো পয়লা মে তিন ঘণ্টার জন্য বন্ধ থাকবে বলে মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে।

রাজধানীর ফার্মগেইট এলাকায় সিম নিবন্ধন করতে আসা আহসান কামাল বলেন, সকালে গ্রামীণফোনের সিম ?পুনঃনিবন্ধন করতে গেলে প্রথমে তাকে বলা হয় সার্ভার ‘ডাউন’। দীর্ঘসময় অপেক্ষার পর তার সিমের পুনঃনিবন্ধন হয়। কেবল ঢাকা নয়, দেশের অন্যান্য স্থানেও কাস্টমার কেয়ার সেন্টার ও রিটেইলার পয়েন্টে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন করতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়ার কথা জানিয়েছেন গ্রাহকরা। তবে প্রায় দেড় কোটি গ্রাহক সিম নিবন্ধন করতে গেলেও তাদেরটা নানা জটিলতার কারণে হয়নি। এখন পর্যন্ত তাদেরটা বৈধ বলেই ধরে নেয়া হবে।

তারানা হালিম বলেন, ‘সব সিমের তো আর রেজিস্ট্রেশন হবে না। ৯-১০ কোটি গ্রাহক রেজিস্ট্রেশন করলেই আমরা বুঝব সবাই করেছেন। কিছু তো ঝরে পড়বেই। যারা অবৈধভাবে এটা করছেন তাদেরটা তো রেজিস্ট্রেশন হবে না। যারা হুমকি দিচ্ছে, চাঁদা আদায় করছে, তারা তো আর বৈধভাবে রেজিস্ট্রেশন করাবে না। ফলে ১৩ কোটির সবাইকে আমরা এখন পাব না। নতুন করে অনেকে আবার সিম কিনবেন। ফলে গ্রাহক এখন কমলেও পরে বেড়ে যাবে।’

আমাদের মির্জাপুর (টাঙ্গাইল) সংবাদদাতা জানান, বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে মোবাইল ফোনের সিম নিবন্ধনের নামে গ্রাহকদের চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। গ্রাহকের কাছ থেকে সিম প্রতি ২০-৪০ টাকা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে আরও বেশি টাকা আদায় করা হচ্ছে।

আমাদের উখিয়া (কক্সবাজার) সংবাদদাতা জানান, অপ্রতুল বিদ্যুত্ সরবরাহের কারণে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন করতে গিয়ে গতকাল বিপাকে পড়েছেন অনেক গ্রাহক।

Share this content:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button